নাছরিন আক্তার। বয়স ৩৬। বনিবনা না হওয়ায় প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। একপর্যায়ে তিনি তার স্বামীকে তালাক দেন। তাদের একমাত্র মেয়ে নাবিলা আফরিনকে নিয়ে কদমতলী দনিয়ার ৮১৭ গোয়ালবাড়ী মোড়ের দ্বিতীয় তলায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। চলতি বছরের ১৮ মে সন্ধ্যায় তিনি বাসা থেকে বের হন। কিছু সময়ের মধ্যে তার ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ফেরেননি। দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যায় মেয়ে নাবিলা। কোথায় খোঁজ করবে মাকে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। নানি আয়েশা বেগমকে খবর দেয় নাবিলা। তিনি ছুটে আসেন। বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেন। কিন্তু নাছরিন আক্তারের খোঁজ মিলছে না। নানি-নাতনি নির্ঘুম রাত কাটান। পরদিন সকালে তারা আবারও খোঁজ করতে বাসা থেকে বের হন। কিন্তু কেউ কোনো খবর দিতে পারে না। আয়েশা বেগম কদমতলী থানায় এ বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পুলিশ নিখোঁজ নাছরিনের সন্ধানে তদন্ত শুরু করে। এদিকে তিন দিন পর নৌপুলিশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ উদ্ধার করে। মৃতদেহে কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন ছিল। পুলিশ নিশ্চিত যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ বিষয়ে রূপগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলা নম্বর-৩১। শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের ম্যাসেজ আসে কদমতলী থানাতেও। কদমতলী থানা পুলিশ এ বিষয়টি জানায় নাবিলাকে। পুুলিশের কর্মকর্তা নাবিলাকে বলে, শীতলক্ষ্যা নদী থেকে একজন নারীর লাশ উদ্ধার হয়েছে। শনাক্ত করতে তাকে প্রয়োজন। সে যেন রূপগঞ্জ থানায় গিয়ে যোগাযোগ করে। এ খবর শুনে নাবিলা তার নানিকে নিয়ে ছুটে যায় রূপগঞ্জ থানায়। ফুলে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় লাশটি চেনার কোনো উপায় ছিল না। রূপগঞ্জ থানা পুলিশ অজ্ঞাত এ নারীর ব্যবহৃত ঘড়ি, ব্রেসলেট ও আংটি নাবিলার সামনে রাখে। একবার দেখেই নাবিলা চিনতে পারে যে, এসব জিনিস তার মায়ের। লাশ শনাক্ত হয়। নাছরিন আর এ দুনিয়ায় নেই। নাবিলা নিশ্চিত যে, তার মাকে কেউ হত্যা করেছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে খুনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। আয়েশা আক্তার এবার খুনের মামলা করেন। ২৪ জুন তিনি বাদী হয়ে কদমতলী থানায় মামলা করেন।
নতুন করে পুলিশের তদন্ত শুরু হয়। তদন্তের একপর্যায়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে আবদুল হাইয়ের নামটি বারবার চলে আসে। এ আবদুল হাই একজন ব্যবসায়ী। তার একটি বড় ফার্মেসি রয়েছে। পুলিশ জানতে পারে, আবদুল হাইয়ের সঙ্গে ছিল নাছরিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পুলিশের সন্দেহের তালিকায় এখন এক নম্বর নামটি হলো আবদুল হাই। পুলিশ এমন সব তথ্য পেয়েই আটক করে আবদুল হাই এবং তার গাড়িচালক রানাকে। থানায় নিয়ে জেরা করা হয় আবদুল হাই এবং তার গাড়িচালক রানাকে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেন নাছরিনকে খুনের ঘটনা। নাছরিনের সঙ্গে ২০০৯ সালে পরিচয় হয় আবদুল হাইয়ের। তখন থেকে তাদের মধ্যে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কের সূত্রে নাছরিনের যাবতীয় খরচাদি আবদুল হাই বহন করতেন। অথচ আবদুল হাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও নাছরিন আরও কয়েকটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। স্থানীয় লিমনসহ অনেকের সঙ্গে একাধিক পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল নাছরিনের। ফলে আবদুল হাইকে উপেক্ষা করতেন এবং আত্মীয়-পরিজন সবার সামনে বিভিন্নভাবে তাকে অপমান-অপদস্ত করতেন নাছরিন। এসব কারণে আবদুল হাই তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন এবং সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ঘটনার দিন আবদুল হাই যাত্রাবাড়ীতে তার ওষুধের দোকানে আসতে বলেন নাছরিনকে। নাছরিন দোকানে আসার পর তাকে জুসের সঙ্গে চেতনানাশক ডরমিকাম ওষুধ খাওয়ান। এরপর তারা জুতা কেনার উদ্দেশ্যে গুলিস্তান মার্কেটে যান। কিন্তু জুতা না কিনেই প্রচ বৃষ্টি থাকায় তারা লং ড্রাইভে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পথিমধ্যে গাড়িতে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। এবং একপর্যায়ে তা হাতাহাতিতে রূপ নেয়। হাতাহাতির একপর্যায়ে আবদুল হাই গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন নাছরিনকে। মৃত্যু নিশ্চিত করার পর তিনি তার ড্রাইভার মো. রানার সহায়তায় লাশটা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কাঞ্চন ব্রিজের ওপর থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেন। মামলার আসামি আবদুল হাই ও মো. রানা দুজনেই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ায় ক্লুলেস মামলাটির রহস্য উদঘাটিত হয়।