মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনি ছিল ঘরে

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনি ছিল ঘরে

আর কয়েক দিন পরই ঈদ। কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। মিতা যাবেন বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে গোপালগঞ্জে। কিন্তু বাড়িতে যাওয়ার ছয় দিনের মাথায় ঘর থেকেই নিখোঁজ হন মিতা। রাতে দুবোন একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ার পর সকালে বিছানায় পাওয়া যায় ছোট বোনকে। কিন্তু মিতা নেই। মিতার বাবা-মা তার খোঁজ করে। এ ঘর-ও ঘর খুঁজে দেখা হয়। পাশের বাড়ি, পাড়া-প্রতিবেশী সবখানেই খোঁজা শেষ। কিন্তু নেই মিতা। রাতে খাবার শেষে নিজের রুমে শুতে গেল তরতাজা মেয়েটি, সকালে সে নেই। হঠাৎ খবর আসে পাশের একটি পুকুরপাড়ে পড়ে আছে মিতার লাশ। এ খবর শুনে মিতার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাই ছুটে যান। তারা পুকুরপাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন মিতাকে। খবর শুনে আসে পুলিশ। মিতার গলায় কালো দাগের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। পুলিশ নিশ্চিত, তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। ২০১০ সালের ৩০ আগস্টের ঘটনা এটি।  এ ঘটনায় মিতার বাবা লিয়াকত হোসেন মোল্লা বাদী হয়ে ওই দিনই গোপালগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন।

ঢাকা থেকে বাড়িতে ঈদ করতে এসে খুনের শিকার হলেন ইডেন কলেজের ছাত্রী মিতা। পুলিশকে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে। যে মেয়েটি বাড়িতে আসতেন, সেই মেয়েটি কিনা বাড়ি এসে খুন হলেন? তার খুনে কে বেশি লাভমান হলো? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে কিছুই পায়নি পুলিশ। ঘটনার প্রায় দু-তিন দিন পেরিয়ে গেলেও খুনিদের শনাক্ত করতে পারছে না পুলিশ। মিতার পরিবার এ নিয়ে পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ।

পুলিশ জানতে পারে, মিতার সঙ্গে একই এলাকার যুবক ফিরোজের সম্পর্ক ছিল। পুলিশের টার্গেট এখন সেই ফিরোজ। পুলিশ তার বাসায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে। কিন্তু পুলিশ তার কাছ থেকে খুন সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য পায় না। তবে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য পায়। ফিরোজ পুলিশকে জানিয়েছে, মিতার চাচাতো ভাই জনি প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সে ক্ষুব্ধ ছিল মিতার ওপর। পুলিশ চলে যায় জনির বাসায়। তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে জেরা করে। এ সময় জনির কাছ থেকেও কোনো তথ্য পায় না পুলিশ। তবে সে জানায়, তার এক মামাতো ভাই মিতাকে পছন্দ করত। গিফট পাঠাত। প্রেমের প্রস্তাবও দিয়েছিল। কিন্তু মিতা তা প্রত্যাখ্যান করে। পুলিশ এবার ছোটে জনির মামাতো ভাইকে গ্রেফতার করতে। কিন্তু পুলিশ কোনো তথ্যই পায় না তাদের কাছ থেকে। পুলিশ এ খুনের মামলা নিয়ে রীতিমতো বিপাকে। কোনো সূত্রই খুঁজে পাচ্ছে না তারা, যেখান থেকে আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হবে।

পুলিশ এ নিয়ে যখন চিন্তিত ঠিক সেই সময়ে রহস্য উদঘাটনের সূত্র নিজে থেকেই পুলিশের কাছে হাজির। একদিন বিকালে গুড্ডু নামে এক লোক থানায় আসেন। মেম্বার প্রার্থী সেই গুড্ডু থানায় ওসির কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন। পুলিশ মিতা খুনের তদন্ত করতে গিয়েও গুড্ডু নামটি পেয়েছিল। কিন্তু তাকে গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য উপযুক্ত কোনো তথ্য-প্রমাণ ছিল না। সেই গুড্ডু থানায় গিয়ে জনি এবং তার মামাতো ভাইকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সম্পর্কে তারা শালা-দুলাভাই। তার নির্বাচনে এ দুজন অন্যতম কর্র্মী বলে গুড্ডু পুলিশকে জানায়। পুলিশ তাকেই গ্রেফতার করে জেরা করতে থাকে। একপর্যায়ে এ গুড্ডু খুনের সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করে। জনি এবং তার মামাতো ভাইয়ের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তারা খুনের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মতে, ভিতর থেকে দরজা খুলে দেয় চাচাতো বোন শ্রাবণী। এর আগে মিতাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। চাচাতো ভাই জনি ও তার তিন বন্ধু মিলে ঘরে ঢুকে বের করে নিয়ে আসে মিতাকে। তারা পুকুড়পাড়ে নিয়ে হত্যা করে কেটে পড়ে।

পুলিশ সামসুর রহমান জনি (২৭), মো. আনোয়ার হোসেন মনি (২৮), ইসরাত জাহান শ্রাবণী (১৮), জসিমুল ইসলাম জগলুল (২৮) ও মাসুম বিল্লাকে (২৭) গ্রেফতার করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জেলহাজতে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে জনি ও শ্রাবণী নিহত মিতার চাচাতো ভাইবোন। আর জনি, জগলুল ও মাসুম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের সবার বাড়ি গোপালগঞ্জ শহরের মিয়াপাড়ায়।

২০১১ সালের ২৯ মে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে শ্রাবণীর মাধ্যমে মিতাকে অপহরণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে। পরে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী পুকুরে ফেলে দেওয়া হয় বলে পুলিশের অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। পরে এ মামলায় ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক মোতাহার হোসেন তিনজনকে মৃত্যুদন্ড, চারজনকে যাবজ্জীবন ও একজনকে পাঁচ বছরের সাজার রায় দিয়েছিলেন। পরে মৃত্যুদন্ডদেশ অনুমোদনের জন্য আবেদনের (ডেথ রেফারেন্স) পাশাপাশি বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আসামিদের করা সেই আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর সব আসামিকে খালাস দেন হাই কোর্ট।

আদালত সূত্র জানায়, এ মামলায় কোনো চাক্ষুষ সাক্ষী ছিল না। এ ছাড়া মিতার চাচাতো বোন শ্রাবণী যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন, সে জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে বিচারিক আদালত আসামিদের মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবনসহ সাজা দিয়েছিল। ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দুই ধরনের হয়, ইন কালপেটরি (অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে) দেওয়া জবানবন্দি, আরেকটা হচ্ছে এক্স কালপেটরি (নিজেকে অপরাধে না জড়িয়ে) দেওয়া জবানবন্দি। আইনে এক্স কালপেটরি জবানবন্দি আমলযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়।’ ‘শ্রাবণী যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে সেটা এক্স কালপেটরি বা অপরাধে নিজেকে না জড়িয়ে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। অর্থাৎ অপরাধ সংগঠনে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। এখন আমরা শ্রাবণীর বক্তব্যকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বললেও আইন এটাকে শুধু স্টেটম্যান্ট (জবানবন্দি) বলছে। বিচারিক আদালত শ্রাবণীর জবানবন্দিটাকে ইন কালপেটরি ধরে সাজা দিয়েছিল। উচ্চ আদালত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য ও শ্রাবণীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ত্রুটিপূর্ণ বা এক্স কালপেটরি ধরে সব আসামিকে খালাস দিয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর