বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

জুতা চেনাল খুনিকে

মির্জা মেহেদী তমাল

জুতা চেনাল খুনিকে

শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার শৈলা বিলের কচুরিপানায় একটি লাশ আটকে আছে। লাশটি চোখে পড়তেই সেখানে মানুষের ঢল। কেউ চিনতে পারছে না। পুলিশ এসে ভিড় ঠেলে পৌঁছে যায় লাশের কাছে। লাশের পাশে দুই জোড়া জুতা পড়ে আছে। পুলিশ অজ্ঞাত ওই লাশটি সেখান থেকে উদ্ধারের সময় জুতা জোড়াও তুলে নেয়। পুলিশের কাছে তখন ওই জুতাই তদন্তের হাতিয়ার।

গ্রামের জরিনা বেগমও ছুটে যান থানায়। লাশ ততক্ষণে মর্গে। পুলিশের কাছে জরিনা বেগম জানান, তার স্বামী আনসার আলীর খোঁজ পাচ্ছেন না। তাই তিনি এসেছেন থানায়। পুলিশ কর্মকর্তারা বিল থেকে লাশের পাশে পড়ে থাকা জুতা জোড়া দেখান। এক জোড়া জুতা জরিনা বেগমের খুবই পরিচিত। কারণ এ জুতা জোড়া তার স্বামী আনসার আলীর পরতেন। জুতা দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। অজানা আশঙ্কায় ছুটে যান হাসপাতালে। স্বামীর লাশ শনাক্ত করেন। অটোরিকশা চালক আনসার আলীর এমন কোনো শত্রু ছিল না যে তাকে কেউ খুন করতে পারে। জরিনা বেগম অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে শ্রীবরদী থানায় মামলা করেন। ঘটনাটি ২০২০ সালের জুলাইয়ের। পুলিশ তদন্তে নামে। কিন্তু কোনো সূত্র খুঁজে পায় না তদন্ত এগিয়ে নিতে। দুই জোড়া জুতার এক জোড়া আনসার আলীর। তা জরিনা বেগম নিয়ে যান। পুলিশের হাতে সবেধন নীলমণি এক জোড়া জুতা। এ জুতা দিয়ে কীভাবে তদন্ত এগিয়ে নেবেন এসব ভাবছেন পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা।

পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা ওই জুতা নিয়েই মাঠে নামেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন এ জুতা জোড়া নিয়ে তিনি গ্রামের পর গ্রাম ঘুরবেন। খুঁজে বের করবেন জুতার মালিককে। তিনি জুতা দেখান গ্রামের লোকজনকে কেউ চিনতে পারে কি না। এমন করতে করতে বেশ কয়েকটি গ্রাম তার ঘোরা শেষ হয়ে গেছে। সন্ধান মেলেনি জুতার মালিকের। এক সপ্তাহ পর জুতা ব্যবহারকারীর পরিচয় শনাক্তের জন্য একটি ক্লু খুঁজে পান তদন্ত কর্মকর্তা। একই রকম নতুন এক জোড়া জুতা সাগর নামে এক তরুণের পায়ে রয়েছে। এমন খবরে সাগরকে সন্দেহের তালিকায় নিয়ে পুলিশ তার বাড়ি হাজির হয়। থানায় নিয়ে জেরা করা হয়। সাগর জানায়, তার আগের জুতাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ায় ২৯ জুলাই সে নতুন জুতা কিনে আনে। তার পুরনো জুতাগুলো দেখানোর জন্য তাকে তার বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ঘর থেকে সাগর পুরনো জুতা আনার কথা বলে কৌশলে পালিয়ে যায়। এরপর সাগরের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরের কললিস্ট পর্যালোচনায় দেখা যায় ঘটনার দিন তার অবস্থান ছিল শৈলার বিলে। পুলিশ নিশ্চিত খুনির নাগাল তারা পেয়ে গেছে। পরে সাগরের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অভিযান চালায় পুলিশ। খুনের ১৯ দিন পর ধরা পড়ে সাগর। এ সময় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের নাম প্রকাশ করে।

তার দেওয়া তথ্যমতে পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিল্লাল মিয়া ও সাইম মিয়াকে গ্রেফতার করে এবং তারা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা জানান, দুজন সদর উপজেলার তাতালপুর বাজার থেকে আনসার আলীর অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে কালীবাড়ী বাজারে যান। গন্তব্যে পৌঁছে তারা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম ভাড়া দিতে চাইলে আনসার আলী নিতে অস্বীকৃতি জানান। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। তখন ওই দুজন তাদের আরেকটু এগিয়ে দিতে বলেন এবং সেখানে তাদের লোকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে দেবেন বলে জানান। একপর্যায়ে অটোরিকশা চালককে নিয়ে দুজন কালীবাড়ী থেকে কুরুয়া সড়কে যাওয়ার সময় শৈলার বিলের মাঝামাঝি বড় ব্রিজের কাছে এসে ভাড়া না দিয়ে উল্টো তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু করেন। তখন সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করা তাদের লোকজন আনসার আলীকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি মারতে থাকেন এবং তার পকেটের টাকা কেড়ে নেন। তাদের মধ্যে একজন আনসার আলীর গলা চেপে ধরে ধাক্কা দিলে ব্রিজ থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। তখন পাঁচ-ছয় জন আনসার আলীকে পানিতে চুবিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর আরও চার-পাঁচ জন আনসার আলীর শরীর থেকে শার্ট ও লুঙ্গি খুলে লাশ বিলের কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে রাখেন। সাগর সেখান থেকে যাওয়ার সময় তার জুতা ফেলে যায়। পরে একই ধরনের এক জোড়া জুতা বাজার থেকে কিনে পরে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর