বুধবার, ৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

নাশকতা পরিকল্পিত লক্ষ্য ছিল সরকার পতন

হেফাজতে ইসলাম নেতাদের জবানবন্দিতে তথ্য

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

নাশকতা পরিকল্পিত লক্ষ্য ছিল সরকার পতন

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘিরে হেফাজতে ইসলামের নাশকতার ঘটনা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। বাস্তবায়নের এক মাস আগেই করা হয় নাশকতার ছক। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমন্বয় করেই এ পরিকল্পনা করা হয়। নাশকতার মাধ্যমে সরকারের পতনই ছিল তাদের লক্ষ্য।

২৬ মার্চ হাটহাজারী নাশকতার ঘটনা তদন্ত এবং গ্রেফতার হওয়া আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এরই মধ্যে এ ঘটনায় দায়ের হওয়া সিংহভাগ মামলার তদন্ত শেষ করেছে পুলিশ। এতে প্রায় ৮০০ জনকে আসামি করে শিগগির দেওয়া হবে মামলার চার্জশিট। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হেফাজতের প্রয়াত আমির আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তৎকালীন সময়ের শীর্ষ নেতারা বিএনপি, জামায়াত এবং ইসলামী সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে লক্ষ্য করে নাশকতার পরিকল্পনা করে। ঘটনার এক মাস আগে এ পরিকল্পনা করা হয়। সে অনুযায়ী এ বছরের ২৬ মার্চ ও পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। ওই আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দেওয়াই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে ইস্যু করে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। নাশকতায় বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন নেতা জোগান দেন কর্মী। আর্থিক সহায়তা দেন ঢাকা চট্টগ্রামের কয়েকজন ব্যবসায়ী। ঘটনার প্রায় এক মাস আগে থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে একাধিক গোপন বৈঠক করেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা। ওই বৈঠকে তৈরি করা হয় নাশকতার পরিকল্পনা। এরপর ঘটনাগুলোর ঠিক এক এক দিন আগে ঢাকা ও হাটহাজারী মাদরাসায় একাধিক গোপন বৈঠক হয়। গ্রেফতার হওয়া হেফাজতে ইসলামের নেতাদের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতেও উঠে আসে নাশকতা পরিকল্পনার নানা তথ্য। হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা নাছির উদ্দিন মুনিরের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির সফর ঠেকাতে ৬ মার্চ ঢাকায় গোপন বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত এবং সমমনা ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী নেতারাসহ ঢাকা চট্টগ্রামের কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে ২৬ মার্চের আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা হয়। ২৪ মার্চ ফের হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা ঢাকায় বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২৬ মার্চের আন্দোলনে সরকার বাধা দিলে তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দেওয়া হবে। হেফাজতে ইসলামের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের প্রতি আমাদের নির্দেশনা ছিল বিভিন্ন ইসলামী দল, বিএনপি, জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার। গত ৬ মার্চ বিএনপি, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়। ২৪ মার্চ বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার পর ২৬ মার্চ সারা দেশে সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়।

হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর ব্যক্তিগত খাদেম এনামুল হক ফারুকী আদালতে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন,  হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতৃত্ব সরকার পতনের জন্য পরিকল্পনা করে। তারা বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন মাহফিল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিতে থাকে। সরকারকে উৎখাত করতে পরিকল্পিতভাবে ২৬ মার্চ দেশব্যাপী নাশকতার সৃষ্টি করে। হেফাজতে ইসলামের সাবেক প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি ফেসবুক আইডি রয়েছে,  যা একাধিক নেতা ও হেফাজতে ইসলামের আমিরের ব্যক্তিগত সহকারীরা পরিচালনা করে। ২৬ মার্চের আগে ও পরের গুজবগুলো ওই আইডি থেকে প্রচার করা হয়। ঢাকার ঘটনার গুজব নিয়ে ওই আইডি থেকে অপপ্রচার করা না হলে দেশব্যাপী নাশকতার ঘটনা এড়ানো যেত।

হেফাজতে ইসলামের সাবেক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মুফতি হারুন ইজহার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের ইন্ধন ও নির্দেশে ২৬ মার্চ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নাশকতার ঘটনা ঘটে। হেফাজতে ইসলাম, বিএনপি এবং জামায়াত নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র ও সরকারকে অস্থিতিশীল করা। তারা স্বার্থ হাসিল করার জন্য মাদরাসার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছে।

৮০০ জনকে  আসামি করে দেওয়া হবে চার্জশিট : চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সরকারি স্থাপনায় তান্ডবের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার সিংহভাগ তদন্ত শেষ করেছে পুলিশ। হাটহাজারী থানা পুলিশ তদন্ত করা মামলাগুলোয় এরই মধ্যে প্রায় ৩০ জন হেফাজতে ইসলামের নেতা ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্ত ও আসামিদের জবানবন্দি শেষে করে চার্জশিট তৈরি করছে পুলিশ। তদন্ত শেষ করা পাঁচ মামলায়  হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ প্রায় ৮০০ জনকে আসামি করা হবে। এর মধ্যে থানা হামলা ও সড়ক অবরোধ মামলার প্রতিটাতে কমপক্ষে ২৫০ জন, পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর, পুলিশের কাজে বাধা মামলায় ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করা হচ্ছে।  হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ছাড়াও মামলাগুলোতে বিএনপি ও জামায়াতের কয়েকজন নেতাকে আসামি করা হবে। মামলাগুলোতে আসামি করা হচ্ছে, বর্তমান মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী, সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক মামুনুল হক, নাছির উদ্দিন মুনীর, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস, কেন্দ্রীয় নেতা হারুন ইজহার, আহমেদ আবদুল কাদের, খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, জাকারিয়া নোমান ফয়জীসহ বর্তমান ও সদ্য বিলুপ্ত কমিটির প্রভাবশালী নেতারা। গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির সফরকে ঘিরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় তান্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তারা সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। এ ঘটনায় হাটহাজারী থানায় আটটি মামলা দায়ের করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর