শুক্রবার, ৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

এক খুনের তদন্তে আরেক খুনের রহস্য

মির্জা মেহেদী তমাল

এক খুনের তদন্তে আরেক খুনের রহস্য

রাজধানীর বাড্ডা থানাধীন আফতাবনগরে নিজ বাসায় চার বছর আগে খুন হন এ কে এম মনজিল হক। খুনিরা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে, পেটে খুঁচিয়ে এবং হাত ও পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরপর হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও রক্তমাখা জামাকাপড় ঘটনাস্থলে ফেলে বাসায় থাকা নিহতের জামাকাপড় পরে পালিয়ে যায় হত্যাকারীরা। ঠিক একই দিন নিখোঁজ হন মনজিলের সৎ ভাই ইয়াসিন। এক দিনেই একটি পরিবারের দুই সদস্যের এমন ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। মনজিল খুনের ঘটনায় তার চাচা ফারুক বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয় এজাহারে। এ ছাড়া তাদের সৎ ভাই ইয়াসিনের নিখোঁজের বিষয়ে একই ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করে জিডি করা হয় থানায়। ঘটনাটি ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বরের।

পুলিশ আসে। খুন আর নিখোঁজের তদন্ত শুরু হয়। সূত্রবিহীন এই হত্যাকান্ডের তদন্তে নেমে প্রথমে কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ এই হত্যাকান্ড ও নিখোঁজের রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে সিআইডি। তিন বছর পর এ সময় মনজিলের খুনিরাই ইয়াসিনকে  অপহরণ করে খুন ও লাশ গুম করেছে বলে সিআইডিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন তাদের চাচা ফারুক মিয়া। কিন্তু সিআইডি গোপন সূত্রে জানতে পারে, পরিচয় গোপন করে ইয়াসিন চট্টগ্রামে একটি সংবাদপত্রের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন। পরে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে শনাক্ত করে চলতি বছর ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর শেরশাহ কলোনি থেকে তাকে গ্রেফতার করে। তার তথ্যমতে, এক দিন পরেই রাজধানীর কোনাপাড়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আরেক খুনি সিয়ামকে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গত ৮ এপ্রিল ডেমরা থেকে রাকিব ও ১২ জুন জুরাইন রেলগেট থেকে তাকবীরকে গ্রেফতার করে সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াসিন জানিয়েছেন, পৈতৃক সম্পত্তির লোভেই সৎ ভাইকে হত্যা করেছেন তিনি। এ জন্য ঘটনার ৮-১০ দিন আগে ভাড়াটে খুনিদের সরদার সিয়ামকে নিয়ে নিউমার্কেটের ফুটপাথ থেকে দুটি ধারালো ছুরি, পাটের রশি ও এগুলো বহনের জন্য একটি রেকসিনের ব্যাগ কিনেন। মনজিলকে হত্যার আগের দিন সিয়ামের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন তিনিসহ তার মা লিপি, চাচা ফারুক মিয়া ও মামা আবু ইউসুফ নয়ন। বনশ্রীতে নিজের পৈতৃক ফ্ল্যাটে এই বৈঠক করা হয়। মনজিলকে হত্যার জন্য সিয়ামকে ৫ লাখ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। এ ছাড়া খুনের কাজে ব্যবহারের জন্য মামা আবু ইউসুফ নয়নের কাছ থেকে নেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা। সিআইডি জানতে পারে, মনজিলের বয়স যখন ৩-৪ বছর তখন তার বাবা মইনুল হকের সঙ্গে তার খালা লিপির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে লিপির প্ররোচনায় মনজিলের মা সাদিয়া পারভীনকে গায়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করে তার বাবা। তবে এই হত্যাকান্ডকে তখন দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেন মইনুল এবং এক বছর পর লিপিকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তান এবং মনজিলকে নিয়ে শান্তিনগর বাজারের পেছনের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেন মইনুল। এই ফ্ল্যাটের যৌথভাবে মালিক ছিল মনজিল, ইয়াসিন ও তাদের চাচাতো ভাই ফারুক মিয়ার ছেলে এ কে এম নেওয়াজ। কিন্তু ইয়াসিনের বয়স যখন ১২-১৩ বছর তখন তার বাবা তাদের দুই ভাইয়ের নামে দলিল করে ফ্ল্যাটটি গোপনে বিক্রি করে দেন। সেই টাকার ভাগ চাইলে ফারুক মিয়াকে মাদকাসক্ত বানিয়ে দীর্ঘদিন একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়। এই ক্ষোভের বশেই মনজিল হত্যার পরিকল্পনায় অংশ নেন ফারুক। এ ছাড়া মৃত মায়ের স্বর্ণালঙ্কারের জন্য একবার ইয়াসিনের মামা আবু ইউসুফকে লাঞ্ছিত করেন মনজিল। যার প্রতিশোধ নিতে ইউসুফও মনজিল হত্যায় সম্মতি দেন।

সর্বশেষ খবর