বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

মুসলিম সভ্যতার অনন্য নিদর্শন

কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর

মুসলিম সভ্যতার অনন্য নিদর্শন

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর এলাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘সাতৈর শাহী মসজিদ’। মসজিদটি মুসলিম সভ্যতা ও স্থাপত্যের অনন্য বিস্ময়কর নিদর্শন হিসেবে বিদ্যমান। ৯ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৬২ ফুট, উচ্চতা ৩০ ফুট, মাটির নিচে অদৃশ্য অবস্থায় রয়েছে আরও ১০ ফুট। মসজিদটির দেয়াল ৫২ ফুট চওড়া। মসজিদটি নির্মাণে জানালা-দরজা ছাড়া কোথাও লোহার রড কিংবা কাঠের বর্গা ব্যবহার করা হয়নি। এর রয়েছে ৯টি বৃহৎ আকারের গম্বুজ, যা সবার কাছে এখনো বিস্ময়কর। মসজিদটির নির্মাতা এবং নির্মাণকাল নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য কেউই জানেন না। তবে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে যা জানা যায়, তা হলো আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে দিল্লির বাদশাহ ছিলেন আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ। তখন এই সাতৈর গ্রামে বহু আউলিয়ার বসবাস ছিল। তাদের মধ্যে হজরত শাহ সুফি সায়ক শাহ ছতুরী (রহ.) এর মুরিদ ছিলেন আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ। ঐতিহাসিক এই মসজিদটি সেই সময় নির্মিত হয়। সাতৈর শাহী মসজিদের পাশ ঘেঁষেই ছিল গ্রান্ড ট্রাংক রোড বা শের শাহ সড়ক। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, সাতৈর শাহী মসজিদটি শের শাহ আমলের কীর্তি। বর্তমানে মসজিদটি  প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে কালের নীরব সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে। যদিও মসজিদের নানা অংশ সংস্কার করা হয়েছে।

ইতিহাসবিদদের মতে, ভূষণা (বর্তমানে বোয়ালমারী) এলাকাটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। বহু সুফি, দরবেশ, আউলিয়া এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য আসেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। এখানে যারা বসতি স্থাপন করেন তাদের মধ্যে ১২ জনের নাম জানা যায়। এরা হলেন হজরত শাহ কলিমুল্লাহ (রহ.), হজরত শাহ লাল (রহ.), হজরত শাহ সুফি শাহ আলী তরী (রহ.), হজরত শাহ সুফি মুছিহাক্কানী (রহ.), হজরত শাহ সুফি শাহ জালাল বাগদাদী (রহ.), হজরত শাহ বাখোরী (রহ.), হজরত শাহ সুফি বুটটি বাগদাদী (রহ.), হজরত শাহ সুফি চান্দ বাগদাদী (রহ.), হজরত শাহ জায়েদ বাগদাদী (রহ.), হজরত শাহ সুফি ময়েজউদ্দিন ইয়েমেনী (রহ.), হজরত উড়িয়ান শাহ (রহ.), হজরত শাহ মইজদ্দীন কানী (রহ.)। এসব সুফি দরবেশের অধিকাংশের মাজার এই গ্রামে অবস্থিত।

 হজরত শাহ কলিমুল্লাহ (রহ.) ও হজরত শাহ লাল (রহ.) ছিলেন আপন দুই ভাই। মসজিদের কয়েক গজ দক্ষিণে তাদের বৃহদাকার জোড়া মাজার রয়েছে। মসজিদের দু-তিন শ হাত দূরে বিশাল জঙ্গলের মধ্যে আটজন আউলিয়ার মাজার রয়েছে, যেগুলোর অবস্থান নির্দিষ্ট নেই। যদিও তাদের সম্মানে স্থানীয় বাসিন্দারা এখনো জুতা পায়ে ওই সীমানায় প্রবেশ করেন না। মসজিদের পাশে বিশাল আকারের একটি পুকুর রয়েছে, যার নাম ‘দুধপুকুর’। ২০ একর জমির ওপর বিশাল এ পুকুরটি নিয়ে লোকমুখে নানা কাহিনি এখনো ছড়িয়ে বেড়ায়। মুসলিম স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হিসেবে সাতৈর শাহী মসজিদ নিয়ে বিভিন্ন কাহিনি এলাকায় প্রচলিত আছে। যেমন মসজিদটি আল্লাহর হুকুমে এক রাতের মধ্যে মাটি ফেটে গজিয়ে ওঠে। মসজিদের ভিতরের খুঁটি চারটি বিভিন্ন সময় হাসে-কাঁদে। মসজিদের পিলারের কাছে যা আশা করা যায় তা-ই পাওয়া যায়। মসজিদের ইট বাড়িতে রাখলে উই পোকা লাগে না। মসজিদের ধূলি গায়ে মাখলে যে কোনো ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মসজিদে এসে মানত করলে নিঃসন্তানদের সন্তান হয়। আর এসব বিশ্বাস করে ১০-১২ বছর আগে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে নারী-পুরুষ আসত নানা মানত নিয়ে। বর্তমানে সেই মানত নিয়ে আসা লোকজনের আগমন একেবারেই কমে গেছে। স্থানীয় আলেমরা এগুলোকে কুসংস্কার ও ইসলাম পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ৩০ বছর আগে এ এলাকায় চৈত্র মাসের শুরুতে মেলা হতো। কিন্তু শিরকের ছড়াছড়ি দেখে মেলাটি বন্ধ করে দিয়েছেন আলেমরা।

বর্তমানে মসজিদটি সংস্কারের নামে ঐতিহাসিক কাঠামো বিনষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে। আগের কাঠামো নষ্ট করে টাইলস দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়েছে মসজিদের ভিতরের অংশে। ফলে মসজিদটি হারিয়েছে তার প্রকৃত চেহারা। এমনকি সংস্কারের নামে বর্ধিত অংশ নির্মাণ করা হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখনো পর্যটকেরা আসেন ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ঐতিহাসিক সাতৈর শাহী মসজিদটি দেখতে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর