বুধবার, ৬ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

মিসড কলের ফাঁদ!

মির্জা মেহেদী তমাল

মিসড কলের ফাঁদ!

কুমিল্লার দাউদকান্দি মহাসড়কের পাশের একটি ঝোপের সামনে মানুষের জটলা। প্রত্যেকের দৃষ্টি ঝোপের দিকে। সেখানে পড়ে আছে বড় একটি সুটকেস। কী আছে তাতে? এমন প্রশ্ন উৎসুক মানুষের মধ্যে। এ খবর চলে যায় পুলিশের কাছেও। পুলিশ আসে। প্রচ- ভারী সুটকেসটি টেনে তুলতে বেগ পেতে হচ্ছিল দুই পুলিশকে। লোকজনের সহায়তায় সেটি ঝোপ থেকে রাস্তার ওপর তোলা হয়। সুটকেসটি দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়। মাছি উড়ছিল সুটকেসের চারপাশ ঘিরে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয় বিষয়টি। তারাও সেখানে ছুটে আসেন। সুটকেসের তালা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পুলিশ তালা ভেঙে সুটকেসটি খোলে। মানুষের মুখে তখন ভয় পাওয়ার নানা শব্দ। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। কারণ সুটকেস খুলতেই বেরিয়ে আসে কম্বল মোড়ানো আস্ত মানুষের লাশ! লাশটি উদ্ধারের পর মর্গে পাঠানো হয়। পুলিশ অজ্ঞাতনামা ওই পুরুষের লাশের পরিচয় জানতে তদন্ত শুরু করে।

বেশ কদিন অজ্ঞাত থাকলেও একপর্যায়ে পুলিশ জানতে পারে, এটি একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর লাশ। নাম তার জাহাঙ্গীর হোসেন। যাত্রাবাড়ী থেকে তিনি অপহরণ হয়েছিলেন। লাশের পরিচয় জানার পর ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঘটনার পাঁচ মাস পর ওই হত্যার রহস্য উদঘাটন করে পুলিশ। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। একটি মিসড কলের ফাঁদে পড়ে জীবন দিতে হয়েছে উদীয়মান ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেনকে।

জাহাঙ্গীর খুনের ঘটনায় প্রথমে পুলিশ যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করে আফসানা মিমি নামের এক নারীকে। পরে তার দেওয়া তথ্যমতে গ্রেফতার করা হয় অপহরণ ও হত্যায় সহযোগী নূরে আলম, জাহাঙ্গীর আলম স্বাধীন ও প্রতীককে। সর্বশেষ চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে গ্রেফতার হয় আফসানা মিমির স্বামী সৈকত আহম্মেদকে। পুলিশ জানায়, এরা ভয়ংকর চক্র। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সৈকত জানান, ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। তার ধারণা ছিল, তাকে অপহরণ করা গেলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। তাই তার স্ত্রী মিমিকে দিয়ে ফাঁদ পেতে তাকে অপহরণ করা হয়। এরপর তার মুক্তিপণের জন্য ৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। সৈকত জানিয়েছে, শিল্পপতির হাত-পা বেঁধে টাকার জন্য মারধর করার সময় তিনি মারা যান। এতে আর মুক্তিপণের টাকা পাননি। বাধ্য হয়ে লাশটি কম্বলে মুড়িয়ে বড় লাগেজে ভরে মাইক্রোবাসে কুমিল্লায় ফেলে দেওয়া হয়। এর আগে তার স্ত্রীর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিলেও ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর ছিল তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট। মিমি পুলিশকে জানায়, তিনি প্রথমে জাহাঙ্গীর হোসেনকে মিসড কল দেন। জাহাঙ্গীর হোসেন কল ব্যাক করেন। এরপর থেকেই তার সঙ্গে ফোনে কথা বলত। নানা বিষয় কথা বলতে বলতে এডাল্ট কথা বলা শুরু করত মিমি নিজেই। এতে জাহাঙ্গীর হোসেনের তার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। দেখা করতে চায় জাহাঙ্গীর। মিমি তার বাসার এক অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরকে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি সেখানে গেলে নানা কৌশলে সময় পার করে তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর হাত-পা বেঁধে স্বজনদের ফোন দিয়ে ৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা। টাকা না দেওয়ায় তাকে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়। বেশ কয়েক মাস আগের ঘটনা। রাজধানীর মধ্য পাইকপাড়া থেকে একই ধরনের ‘প্রেম প্রতারক’ চক্রের সদস্য দোলা আক্তারকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পুলিশ তার কাছ থেকে জানতে পারে প্রতারণার নানা ফাঁদের কথা। প্রেম প্রতারণার অভিযোগে দোলা আক্তার গ্রেফতার হওয়ার পর গোয়েন্দা দফতরে তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আসতে থাকে। যারা প্রতারিত হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা শতাধিক বলে জানায় পুলিশ। প্রতারণার শিকার হয়ে যারা মানসম্মানের কারণে বিষয়টি চেপে গিয়েছিলেন, তারাও বিভিন্নভাবে তথ্য দেয় গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র এ তথ্য দিয়ে বলেছে, নিত্যনতুন তথ্য পাওয়া যায় দোলা এবং প্রতারিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে। পুলিশি জেরার মুখে দোলা বলেছে, সমাজের বিভিন্ন বিত্তশালী বা ধনী ব্যক্তিদের ফোন নম্বর এনে দিতেন ডিবির এসি পরিচয়দানকারী চাচা আবু তালেব ও ভুয়া ডিবির পরিদর্শক আজাহার উদ্দিন খানের কাছে। তার কাজ ছিল শুধু ওইসব ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করা। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের নিজের ফ্ল্যাটে এনে দিলেই তার কাজ শেষ। এরপর ব্ল্যাকমেল করে অর্থ হাতানোর কাজটা করত দলের অন্য সদস্যরা। তাদের মধ্যে দোলার আপন খালা প্রতারক প্রেমিকা সালমা বেগম, ভুয়া ডিবির এসআই মোস্তফা ও ভুয়া সাংবাদিক শামীম শিকদার রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তারা প্রেম-প্রতারণার ফাঁদ পেতে পকেট কেটেছে অসংখ্য পুরুষের। দোলা পুলিশের কাছে বলেছে, চাচার দেওয়া নম্বরে প্রথমে মিসড কল দিতাম। একবার নয়, একাধিকবার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই নম্বর থেকে কল ব্যাক করত। আমি একটু কথা বলে বলতাম ‘রং নম্বর’। লাইন কেটে দিতাম। ঘণ্টাখানেক পর আবারও মিসড কল দিতাম। আবার কল ব্যাক করলে কথা বলতাম। মেয়ের গলা পেয়ে অপর প্রান্তের লোক এমনিতেই কথা বলত। একপর্যায়ে সম্পর্ক গাঢ় হতো। তারপর অপর প্রান্তের ব্যক্তিই আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন। প্রথমে রাজি হতাম না। পরে রাজি হয়ে যেতাম। এরপর কোনো রেস্টুরেন্টে দেখা, নানা বিষয়ে কথোপকথন, এডাল্ট বিষয়ে নিয়ে যেতাম আমি নিজেই। এরপর তিনিই আমাকে কোনো ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে চাইতেন। কখনো কক্সবাজার বা অন্য কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইতেন। আমি বলতাম, আমার খালার বাসা ফাঁকা। এখানে আসেন। বাসা ফাঁকা শুনে তিনি সহজেই রাজি হয়ে যেতেন। এভাবেই আমার কাজ ছিল ফ্ল্যাট পর্যন্ত এনে দেওয়া। বাকি কাজ অন্যরা করত। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীসহ সারা দেশে ফোনের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির মানুষকে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করে। এমন চক্র এখন রাজধানী থেকে শুরু করে সারা দেশেই সক্রিয়। আর এ চক্রের ফাঁদে পড়ে জাহাঙ্গীর হোসেনের মতো কেউ কেউ প্রাণ হারান। অনেকেই টাকার বিনিময়ে মুক্তি পান। মানসম্মানের জন্য তারা মুখ খোলেন না। এমন মিস কলের প্রলোভনে পড়ে নিজের জীবনকে হুমকির মধ্যে না ফালানোর জন্যই পরামর্শ দিয়েছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর