রবিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

গোপন প্রেমিককে গোপনে খুন

মির্জা মেহেদী তমাল

গোপন প্রেমিককে গোপনে খুন

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার উয়ার্শী-বালিয়া সংযোগ রাস্তার পাশেই পড়ে আছে এক ব্যক্তির লাশ। লাশ ঘিরে আছে পথচারীরা। কেউ চিনতে পারছে না। খবর পেয়ে ছুটে আসে পুলিশ। লাশের সুরতহাল তৈরি করছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। গলায় কালো চিহ্ন। এ ছাড়া আঁচড়ের দাগ রয়েছে শরীরে। পুলিশ নিশ্চিত হতভাগ্য ব্যক্তিকে অন্য কোথাও হত্যার পর রাস্তার পাশে ফেলে রেখে গেছে। গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা এটি।

পুলিশ অজ্ঞাত এই লাশের পরিচয় উদ্ধারের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছেন। আশপাশের থানাগুলোয় খবর নিচ্ছে। কোনো নিখোঁজ জিডি হয়েছে কি না। কিন্তু এমন কোনো জিডি  আশপাশের থানায় হয়নি। একদিন পর এক তরুণ থানায় এসে হাজির। তার নাম কাওসার মিয়া। তিনি পুলিশকে জানান, তার বাবা আবদুল হালিমকে খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। পুলিশ তাকে মর্গে নিয়ে যান। লাশ দেখেই চিনতে পারে কাওসার। এটা তার বাবার লাশ।

পুলিশ লাশের পরিচয় পেয়ে যায় কোনো রকম ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই। কাওসার এ ব্যাপারে মির্জাপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। প্রতিদিনের মতো ৩ আগস্ট সকালে মানিকগঞ্জের বাসা থেকে বেরিয়ে যান কাওসারের বাবা হালিম। তিনি পেশায় একজন পিকআপ চালক। তার নিজস্ব পিকআপ নিয়ে ঢাকা আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় কাঁচামাল নিয়ে ট্রিপে যান। এরপর সেখান থেকে বেলা ৩টার দিকে ফিরেও আসেন। সন্ধ্যায় ছেলে কাওছার তার সঙ্গে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করলেও কেউ ফোন রিসিভ করে না। পরদিন মির্জাপুরে তার লাশ পাওয়া যায়। পিকআপটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ধামরাইয়ের জয়পুরা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা ছিল হয়তো ছিনতাইকারী বা ডাকাতদের কবলে পড়েছিলেন হালিম। পিকআপ ভ্যান ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় তাকে হত্যা করা হতে পারে। এ পথে পুলিশের তদন্ত বেশিদূর এগোয় না। ছিনতাইকারী বা ডাকাতদের কবলে পড়ার মতো কোনো তথ্য পায় না পুলিশ কোনো সূত্র থেকেই। পুলিশ তদন্ত করতে যেয়ে একটি নাম পায় বিভিন্ন সূত্র থেকে। তিনি হলেন হালিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহিন আলম। এই শাহিন আলমের বাড়ি ধামরাইয়ের কালামপুরে। হালিম তার বন্ধুর বাড়িতে প্রায়ই যেতেন। পুলিশ শাহিন আলমের বাড়িতে যায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। কিন্তু বাড়ির দরজায় তারা তালা ঝুলতে দেখেন। এতে শাহিন আলমের ওপর সন্দেহটা বাড়তে থাকে পুলিশের। পুলিশের এখন টার্গেট শাহিন আলম। পুলিশ তার খোঁজে মাঠে নামে। তাকে কোথাও না পেয়ে পুলিশ শাহিন আলমের শ্বশুরবাড়ি নাটোরে অভিযান চালায়। সেখান থেকে পুলিশ খুঁজে পায় শাহিন আলমের স্ত্রী শিউলি বেগমকে। শিউলি বেগমকে সেখানেই জেরা করে পুলিশ। খুনের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় সেখানেই। পুলিশ শিউলিকে আটক করে নিয়ে যায় মির্জাপুর থানায়। তাকে আবার শুরু করা হয় জেরা। শিউলি বেগম খুলে বলে হালিম খুনের আদ্যোপান্ত।

পুলিশ জানতে পারে, শিউলির স্বামী শাহিন আলম ও আবদুল হালিম দুজন ড্রাইভার ছিলেন। সেই সূত্রে হালিম ও শাহিন আলমের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। ধামরাইয়ের কালামপুরে তাদের ভাড়া বাসায় প্রায়ই যাতায়াত ছিল আবদুল হালিমের। সেই সম্পর্ক ও যাতাযাতের রেশ ধরেই এক সময় শাহিন আলমের স্ত্রী শিউলির সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন আবদুল হালিম। বিষয়টি ধীরে ধীরে জানতে পারে শাহিন আলম। একদিন তাদের ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলে শাহিন আলম। কিন্তু বিষয়টি শাহিন আলম গোপন রাখে। একদিন শাহিন আলম তার স্ত্রীকে পরকীয়ার বিষয়টি জানায়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। শিউলি আক্তার তার স্বামীর কাছে ক্ষমা চান। শাহিন আলম তার স্ত্রীকে বলেন, ক্ষমা করতে পারি, শর্ত আছে। শিউলি যে কোনো শর্ত মানতে রাজি হয়। এরপর শাহিন আলম প্রেমিক হালিমকে খুন করবে বলে পরিকল্পনার কথা জানায়। এতে রাজি হয় শিউলি। শিউলি পরিকল্পনা মাফিক অন্যান্য দিনের মতো ৩ আগস্ট হালিমকে ফোন করে। বলে, তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো। বাসা পুরো ফাঁকা। প্রেমিকার এমন আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিনই সন্ধ্যায় ধামরাই যেয়ে হাজির হন হালিম। হালিম বাসায় আসার পর ঘুমের ওষুধ মেশানো শরবত খাওয়ায় শিউলি। এতে ঘুমিয়ে পড়ে হালিম। পরিকল্পনা মতো শাহিন আলম এবং শিউলি মিলে হালিমকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। হত্যার পর রাতের আঁধারে তার লাশ মির্জাপুর উপজেলার উয়ার্শী ইউনিয়নের উয়ার্শী গ্রামের রাস্তার পাশে ফেলে যান তারা।

শিউলিকে টাঙ্গাইল জেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রুপন কুমার দাসের আদালতে হাজির করা হলে ১৬৪ ধারায় হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি কারাগারে। অপর খুনি তার স্বামীকে খুঁজছে পুলিশ।

সর্বশেষ খবর