বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

লাখ টাকার ভাড়াটে খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

লাখ টাকার ভাড়াটে খুনি

রাজধানীর পূর্ব গোড়ানের বাসিন্দা জাহিদ হোসেন। ২০০৫ সালের ২০ মে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন তাহমিনা শারমিন তানিয়াকে। প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। কিছুদিন যেতেই সেই ভালো আর থাকেনি। স্ত্রীকে কথায় কথায় গালমন্দ করতেন জাহিদ। বিয়ের আগে জাহিদের সঙ্গে তার খালাতো বোনের প্রেম ছিল। দাম্পত্য কলহের অন্যতম কারণ ছিল তা। প্রেমের সম্পর্ক না থাকলেও জাহিদ তার প্রেমিকাকে ভুলতে পারেননি। তানিয়া তার জীবনে না এলে হয়তো প্রেমিকাকেই বিয়ে করতেন। এমন এক পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে খুনসুটি লেগেই থাকত। এক বছর পর তাদের একটি পুত্র সন্তান হয়। তানিয়া ভেবেছিলেন হয়তো সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও তার স্বামী তার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখবেন। সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকে। জাহিদ তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন। আগের মতো করে আর অযথাই গালমন্দ করেন না। এতে তানিয়া ভীষণ খুশি। এরই মধ্যে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যেতে চান জাহিদ। তারা কুয়াকাটায় যাবেন। তানিয়াকে বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হন। ২০০৭ সালের ২৭ জানুয়ারি তারা ১০ মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে নিজস্ব গাড়িতে  কুয়াকাটা যান। কুয়াকাটা বেড়িয়ে তিন দিন পর ৩০ জানুয়ারি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। ফেরার পথে রাত ১১টায় পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় তাদের গাড়িটি নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক ওই সময়েই ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তারা। ছিনতাইকারীরা জাহিদ এবং তার স্ত্রী তানিয়াকে উপর্র্যুপরী ছুরিকাঘাত করে টাকা পয়সা, মোবাইল ফোন, ঘড়ি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। জাহিদ প্রাণে রক্ষা পেলেও ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তানিয়া। এ ঘটনায় কলাপাড়া থানায় মামলা করেন নিহতের ভাই রায়হান গফুর। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে ভয়ানক সব তথ্য। পুলিশ নিশ্চিত হয়, তানিয়া ছিনতাইকারীর হাতে খুন হননি। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর এই হত্যার পরিকল্পনাকারী স্বামী জাহিদ নিজেই। ১ লাখ টাকায় কিলার হায়ার করে তানিয়াকে হত্যা করে। এ ঘটনায় স্বামী জাহিদ হোসেন, গাড়ি চালক শাহিন এবং ভাড়াটে কিলার মিজানকে গ্রেফতার করে। তাদের জবানিতে বেরিয়ে আসে খুনের আদ্যোপান্ত। পরে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন নিহতের স্বামী জাহিদ, গাড়িচালক শাহিন ও ভাড়াটিয়া খুনি মিজান। পুলিশের জেরায় গাড়িচালক শাহিন জানিয়েছে, রাজনীতি করার সময় জাহিদ হোসেনের সঙ্গে ২০০২ সালে পরিচয়। তাদের বিয়েতেও তিনি ছিলেন। হত্যাকান্ডের ৩/৪ দিন আগে জাহিদ তাকে বলে তার ঘনিষ্ঠ একজনকে খুন করতে হবে। ভাড়াটে কিলার মিজানকে জিজ্ঞাসা কর পারবে কি না? মিজানকে বিষয়টি জানায় শাহিন। রাজি হয় মিজান। বলে ১ লাখ টাকা লাগবে। রাজি হয় জাহিদ। শাহিন পুলিশকে জানায়, ২০০৭ সালের ২৭ জানুয়ারি সকালে খিলগাঁও তালতলা মার্কেট থেকে জাহিদ ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে তার স্ত্রীকে উঠিয়ে কুয়াকাটার উদ্দেশে রওনা হই। গাড়িতে জাহিদ, তার স্ত্রী তানিয়া ও দশ মাস বয়সী পুত্র সন্তান ছিল। রাত দেড়টায় কুয়াকাটায় পৌঁছাই। আমি সমুদ্র বিলাসে এবং তারা পর্যটন হোটেলে ওঠেন। পরের দিন মিজান কুয়াকাটায় এসে আমাকে ফোন দেয়। সে একটা ব্যাগে আঙ্গুর, আপেল এবং পেপার দিয়ে পেঁচিয়ে একটা চাকু ও খুর নিয়ে আসে। মিজানও সমুদ্র বিলাস হোটেলে ওঠে। জাহিদ কুয়াকাটায় খরচের জন্য আমাদের ২ হাজার টাকা দেয়। মিজানের কথা অনুযায়ী ৩০ জানুয়ারি বিকালে রওনা হই। মিজান আমাকে বলে তিনটি ফেরি পার হয়ে সামনে আগালে মোবাইল ফোনের আলো দিয়ে সংকেত দিবে। গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে বলে গাড়ি থামাতে হবে। এসব পরিকল্পনার কথা জাহিদকে জানানো হয়। পরিকল্পনা মাফিক তৃতীয় ফেরি থেকে নেমে দেড় কিলোমিটার সামনে যাওয়ার পর মিজানের সংকেত পায় শাহিন। তখন শাহিন গাড়ি থেকে নেমে সামনের বনেট খুলে। এরই মধ্যে সন্তান নিয়ে জাহিদ গাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভাড়াটে কিলার ততক্ষণে সামনে চলে আসে। তিনি বাম পাশের দরজা খুলে ছুরি দিয়ে তানিয়ার পেটে আঘাত করে টেনে গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। তানিয়া ওঠার চেষ্টা করে এবং বলে জাহিদ আমাকে বাঁচাও। কিন্তু জাহিদ তার রক্তাক্ত স্ত্রীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। মিজান আবার আঘাত করে। জাহিদ তখন গাড়িচালক শাহিনকে বলে, মরেছে কিনা দেখতে। শাহিন নাক মুখ ধরে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়, তানিয়া মারা গেছেন। তখন চালক জাহিদকে বলে, ভাবি মারা গেছেন। মিজান বলে কাজ শেষ। জাহিদ মোবাইল, ঘড়ি, মানিব্যাগ, দেড় হাজার টাকা দেয় মিজানকে। মিজান খুর দিয়ে জাহিদের পিঠে, বুকে ও ঊরুতে পোচ দেয়। শাহিনও পিঠের ডান পাশে চাকু দিয়ে একটা টান দেয়। ছিনতাইয়ের ঘটনা সাজানোর জন্য জাহিদের গায়ে ৪/৫টা হালকা পোচ দেন তারা। জাহিদ এ সময় মিজান আর শাহিনকে চলে যেতে বলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা যেন আবার ফিরে আসে। এ কথা শুনে শাহিন আর মিজান গাড়ি নিয়ে চলে যায়। কিছুদূর যেতেই শাহিন আর গাড়ি চালাতে পারছিল না। তখন মিজান গাড়ি চালায় এবং শাহিন পেছনের সিটে এসে বসে। ৩০/৪০ কিলোমিটার যাওয়ার পর গাড়ি ফেলে রেখে দুজনে পালিয়ে যায়। পরের দিন ঘটনা পত্রিকায় দেখে ভয় পেয়ে যাই। পরে পুলিশ শাহিনকে গ্রেফতার করে। এই হত্যা মামলায় ২০০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর জেলা ও দায়রা জজ তিনজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়। পরে মৃত্যুদন্ডের রায় নিশ্চিতকরণের জন্য নথি ডেথ রেফারেন্স আকারে হাই কোর্টে যায়। পাশাপাশি আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১২ সালের ৮ জুলাই বিচারপতি সৈয়দ মো. জিয়াউল করিম ও বিচারপতি আনম বশিরউল্লাহর ডিভিশন বেঞ্চ আপিল খারিজ করে দিয়ে তিন আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল খোন্দকার দিলীরুজ্জামান ও আসামি পক্ষের অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ আসামিদের আপিল খারিজ করে ফাঁসির রায় বহাল রাখে। ১৪ বছর আগে ভাড়াটে খুনি দিয়ে স্ত্রী হত্যা মামলার আসামি ভাড়াটে খুনি মিজানুর রহমানের আপিল শুনানি হয় গত মঙ্গলবার। এ সময় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, হায়ার কিলারদের (ভাড়াটে খুনি) আমরা ছাড়ি না। এসব খুনিদের বিষয়ে আমাদের কোনো ছাড় নেই। দেশে ভাড়াটে খুনি পাওয়ার বিষয়টি বিপজ্জনক।  পরে আদালত আসামি মিজানুর রহমানের আপিল খারিজ করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। আদালতে মিজানুর রহমানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মুহাম্মদ আশরাফ আলী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ। আইনজীবী মুহাম্মদ আশরাফ আলী বলেন, ‘তাহমিনা শারমিন তানিয়া হত্যা মামলায় তার স্বামী জাহিদ হাসান জুয়েল, শাহিন আলম শাহিন ও মিজানুর রহমানকে বিচারিক আদালত ফাঁসির আদেশ দেয়। পরে সেটি হাই কোর্টও বহাল রাখে। এরপর আমরা মিজানুর রহমানের পক্ষে আপিল করলে শুনানি শেষে মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় দিয়েছে আপিল বিভাগ।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর