মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

এবার শিল্প গ্রুপের নামে এমএলএম

প্রতারকের খপ্পরে নিঃস্ব লাখো গ্রাহক

শামীম আহমেদ

ই-কমার্সের নামে এমএলএম (মাল্টি লেবেল মার্কেটিং) প্রতারণা থামছেই না। এবার ৭৫ বছরের পুরনো গ্রুপ অব কোম্পানিজের নাম ভাঙিয়ে এমএলএম পদ্ধতিতে তিন মাসেই কয়েক লাখ মানুষের শতাধিক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে এসএম গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছে সরকারি চাকরিজীবী থেকে শুরু করে গার্মেন্ট শ্রমিক, দিনমজুর, স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারীও। প্রতারক প্রতিষ্ঠানটির খপ্পরে পড়ে শেষ সম্বল হারিয়ে এখন দিশাহারা কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা স্বামী পরিত্যক্তা শারমিন। এ নিয়ে গত ৩০ অক্টোবর কাউছার আহম্মেদ, হাবিবুর রহমান, মো. জহির ও গিয়াস উদ্দিন নামে চারজনকে আসামি করে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করেছেন ওই নারী। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন শারমিন। তিনি বলেন, আমার স্বামী নেই। সেলাইকাজ ও কসমেটিক্স বিক্রি করে দুই শিশু সন্তান লালন-পালন করছি। দেনমোহরের টাকা ও সারা দিন পরিশ্রম করে দুই লাখের মতো টাকা জমিয়েছিলাম। সব নিয়ে গেছে। তিনি জানান, ১ হাজার টাকা দিয়ে আইডি কিনলে প্রতিদিন ২০ টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল। সেই সঙ্গে নানা রকম বোনাস দেওয়ার কথা। ব্যবসা দেখাতে কাকরাইলে এসএম গ্রুপের অফিসেও নিয়ে যায় আমাকে। দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জমানো ২ লাখ ৬ হাজার টাকার সবটা দিয়েই আইডি কিনি। কিন্তু, একটি টাকাও ফেরত পাইনি। টাকা ফেরত চাইলে তারা নতুন সদস্য জোগাড় করে না দিলে টাকা দেবে না বলে জানায়। পরে গত ২৯ অক্টোবর নতুন সদস্য পাওয়া গেছে জানালে কাউছার ও হাবিব আমার এলাকায় আসে। স্থানীয়দের সহায়তায় তাদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করি। পরদিন মামলা করি। আটকরা জামিন চাইলে আদালত নামঞ্জুর করে অধিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। বাকি দুই আসামি এখনো গ্রেফতার হয়নি। তাদের ফোন খোলা। তারা কোথায় থাকে সেটা পুলিশকে জানিয়েছি। এ ব্যাপারে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা কেরানীগঞ্জ মডেল থানা পুলিশের উপপরিদর্শক মুহাম্মদ মোতালেব হোসেনকে ফোন দিলে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছেন ওই নারী। দুজনকে আটক করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। অন্য আসামি গ্রেফতার বা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো হয়নি। তবে চেষ্টা চলছে। জানা যায়, গত আগস্টের শুরুতে ‘সোশ্যাল মিশন’ নাম দিয়ে ই-কমার্সের আড়ালে এমএলএল প্রতারণা শুরু করে এস এম গ্রুপ নামধারী প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে (https://smshare1.com) দেওয়া আছে ১৯৪৬ সালে শুরু তাদের ব্যবসা। ১ হাজার টাকার আইডি কিনলে প্রতিদিন ২০ টাকা মুনাফার পাশাপাশি নতুন সদস্য যোগদান করালে রেফারেল বোনাস,  জেনারেশন বোনাস, নগদ টাকা, গাড়িসহ নানা উপহারের লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়। লেনদেনের জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে খোলা হয় এজেন্ট অফিস। অক্টোবরেই প্রতিষ্ঠানটি ২০ লাখ সদস্য হয়ে গেছে বলে গ্রাহকদের মাঝে ঘোষণা দেয়। সেই হিসাবে বাজার থেকে উঠেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এর কিছু অংশ শুরুর দিকে মুনাফা হিসেবে গ্রাহকদের দিলেও অক্টোবরের মাঝামাঝি টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। একইসঙ্গে প্রত্যেকের আইডি প্রোফাইলে জমা থাকা টাকার ঘরটিও শূন্য হয়ে যায়।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী (ঢাকার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মী) বলেন, এসএম গ্রুপ নামে বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্প গ্রুপ রয়েছে। গার্মেন্ট, আবাসন, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, সিরামিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, ফুড-বেভারেজ, ট্যুরিজমসহ বিভিন্ন খাতে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ। একই নামের হওয়ায় অনেকেই ভুল করে প্রতারক প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করেন। আমিও ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করি। ৩০ হাজার টাকা ফেরত পেয়েছিলাম। আর পাইনি। আমার পরিচিত অনেকেই লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতারিত হওয়ার পর ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, প্রকৃত এসএম শিল্প গ্রুপটির এমডির নাম সৈয়দ এ কে আনোয়ারুজ্জামান। আর ‘সোশ্যাল মিশন’ নামে এমএলএম প্রতারণা করা এসএম গ্রুপের এমডির নাম শুভ চৌধুরী। একটি প্রতিষ্ঠিত গ্রুপের নামকে সামনে রেখে প্রতারণা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি পুরানা পল্টনের বায়তুল আরিফ টাওয়ার, উত্তর বাড্ডার রূপায়ণ টাওয়ার, উত্তরা, নিকুঞ্জসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অফিস খুলে অন্য ব্যবসার পাশাপাশি এমএলএম প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে থেকেও আইডি বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ৫ হাজার টাকা দিয়ে সোশ্যাল মিশনের পাঁচটি আইডি কেনেন রাজশাহীর মো. মোরসালিন। গতকাল তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিছুদিন দৈনিক ২০ টাকা হারে পেয়েছেন। তবে অর্ধেক টাকাও তুলতে পারেননি। গত এক মাস কোনো টাকা দিচ্ছে না। যে টাকা আইডিতে ছিল সেগুলোও শূন্য করে দিয়েছে। আইনের দ্বারস্থ হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, অনেকে লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ধরা খেয়েছেন। তারাই কিছু করতে পারছেন না। আমরা তো ছোট গ্রাহক। মামলা করলে এর পেছনে দৌড়ঝাঁপ করা কঠিন। এ ব্যাপারে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুভ চৌধুরীর নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দিলে একটি নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যটি খোলা থাকলেও রিসিভ করেননি।

সর্বশেষ খবর