শনিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নকশিকাঁথায় খুনের ক্লু

মির্জা মেহেদী তমাল

নকশিকাঁথায় খুনের ক্লু

যাত্রীর নাম-ঠিকানাবিহীন একটা বাসের টিকিট। আর শিশুদের ৫টা কাঁথা। ব্যস, এ পর্যন্তই। খুনের আলামত হিসেবে এ দুটো জিনিস ছাড়া আর কিছুই পেল না পুলিশ।

ঢাকার একটি আবাসিক হোটেলে অষ্টাদশী এক নারীর লাশ উদ্ধারের পর পুলিশকে ভাবিয়ে তুলেছে। কে বা কারা খুন করে ফেলে রেখে গেছে হোটেলের কেউ তা খেয়াল করেনি। অবশেষে পুলিশকে সেই নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরে চলাচলকারী বাঁধন পরিবহনের রামগতি এলাকার টিকিট আর কাঁথা নিয়েই খুনের তদন্ত শুরু করতে হলো।

গত ২০১৭ সালের ২২ মে রাত ১২টার দিকে ফকিরাপুলের আল শাহীন হোটেলের একটি কক্ষ থেকে হত্যাকান্ডের প্রায় ১৫ ঘণ্টা পর অজ্ঞাত পরিচয় ওই নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

হোটেলের রেজিস্টার খাতায় ওই নারী ও তার সঙ্গে আসা পুরুষটির নাম-ঠিকানা কিছুই লেখা ছিল না। আবার খুনি চলে যাওয়ার সময়ও সে নিজের কিছু রেখে যায়নি। তদন্ত কর্মকর্তার ধারণা, নারীর বাড়ি রামগতির দিকেই হতে পারে। ফলে তিনি বাসের টিকিট, কাঁথা নিয়ে চলে যান লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে। রামগতি বাজারে ঘুরতে থাকেন তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু কোথায় কীভাবে কী করবেন বুঝতে পারেন না। হঠাৎ তিনি দেখতে পান একটি হোমিওপ্যাথিক দোকানে এক শিশুকে নিয়ে এসেছেন এক নারী। শিশুটিকে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে যে কাঁথা দিয়ে, এর সঙ্গে হোটেল কক্ষ থেকে উদ্ধার হওয়া শিশুটির কাঁথা মিলে যায়। তদন্ত কর্মকর্তা শেখ সাইফুল ইসলাম যেন সুড়ঙ্গের ভিতরে আলো দেখতে পান।

তিনি ওই নারীর কাছে জানতে চান তিনি এ কাঁথা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন। মহিলা জানান, রামগতি এলাকায়  এই নকশিকাঁথা বানানো হয়ে থাকে। ফলে সাইফুল ইসলামও নিশ্চিত হন নিহত নারী এ এলাকারই হবেন। আর হোমিওপ্যাথিক দোকানে যেহেতু একই ধরনের কাঁথায় জড়িয়ে শিশুসহ এক নারীর দেখা পান, তাই তদন্ত কর্মকর্তার ধারণা হয় যে, এ দোকানে নিহত নারীর পরিবারেরও কেউ না কেউ আসতে পারে। তা ছাড়া সাধারণ দরিদ্র পরিবারের লোকজনই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিতে আসে। তাই তদন্ত কর্মকর্তা ওই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে নিহত নারীর ছবি দেখান। কিন্তু চিকিৎসক ছবির নারীটিকে চিনতে পারেননি। তবু তদন্ত কর্মকর্তার বিশ্বাস হয়, এখান থেকেই হয়তো পাওয়া যাবে আশার আলো। তাই তদন্ত কর্মকর্তা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের সহযোগিতা চান। চিকিৎসক সহযোগিতা করতে রাজি হন। এর অংশ হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তা একটি ছবি দেন চিকিৎসককে। পরে তা তিনি তার দোকানের সামনে টেবিলের ওপরে থাকা কাচের নিচে রেখে দেন, যাতে সহজেই কারও চোখ পড়ে। দুই দিন পর পুলিশের কাছে ফোন আসে। হোমিও চিকিৎসক ফোন করেছেন। নারীর পরিচয় মিলেছে। দেরি না করে ছুটলেন তিনি রামগতিতে। চিকিৎসক জানান, মেয়েটির নাম রিনা। ওর মামা ছবি দেখে চিনেছেন। রিনার মামা দোকানে ঢোকার পরই টেবিলে কাচের নিচে ছবিটি দেখে চমকে ওঠেন। তিনি এ ছবিটি তার ভাগ্নির মতো মনে হয় বলে চিকিৎসককে জানান। এ সময় চিকিৎসক কাচের নিচ থেকে ছবিটি বের করে দেখান। তখন রিনার মামা নিশ্চিত করেন ছবিটি তার ভাগ্নি রিনারই। রিনার মামা জানান, অনেক দিন ধরে তার ভাগ্নির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার স্বামীর নাম টিপু সুলতান, চট্টগ্রামে থাকে। এরপর চিকিৎসক ফোন করেন তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামকে। আর বেরিয়ে আসে ক্লুলেস একটি হত্যাকান্ডের ঘটনা। এ খবর শুনে ওই দিনই এসআই সাইফুলের নেতৃত্বে মতিঝিল থানার পুলিশ চট্টগ্রামে গিয়ে নগরীর পাঁচলাইশ এলাকা থেকে টিপু সুলতান নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে টিপু জানায়, গার্মেন্টকর্মী রিনা ও তার এক আত্মীয় আড়াই বছর আগে পাঁচলাইশের শুলকবহরের খোকন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি দোকানে একটি চেয়ার কিনতে গিয়েছিলেন। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয় রামগতির মেয়ে রিনা আক্তার সাবিনার সঙ্গে। তাকে ভালো লেগে যায় তার। রেখে দেয় মোবাইল নম্বর। এরপর ফোনে কথা ও প্রেম। দুই বছর আগে পালিয়ে বিয়ে করেন। টিপুর পরিবার বিয়ে মেনে নেয়নি। এরই মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন রিনা। পরে তাকে তার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এরই মধ্যে টিপু আরেকটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। যে কারণে আর খোঁজখবর নেয়নি রিনার। গত ২ মে কন্যাসন্তানের মা হন রিনা। টিপু সন্তানকে দেখতে যাননি। পরে মোবাইল ফোনে রিনা যোগাযোগ করলে টিপু স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকেন। টিপু জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭ মে রিনাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। ঢাকায় কাজ করার কথা বলে রিনা ও তার মেয়ে প্রিয়াকে নিয়ে ২২ মে ভোর রাতে বাসে ঢাকায় চলে আসে। ওঠে ফকিরাপুলের আল শাহীন হোটেলে। হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে আসায় সে রেজিস্টি খাতায় নাম-ঠিকানা না লিখেই বিশ্রামের কথা বলে হোটেলে উঠে যায়। শর্ত দেয়, পরে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে নেবে। দিনের বেলা রিনা ঘুমিয়ে যায়। এক পর্যায়ে তার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় টিপু সুলতান। মাকে যখন গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করছিল; তখন ২১ দিন বয়সী প্রিয়া মায়ের পাশে শুয়ে হাত-পা নাড়াচ্ছিল। হত্যার পর শিশুটিকে লাশের পাশে বসিয়ে রেখে হোটেল কক্ষটি তালাবদ্ধ করে পালিয়ে গিয়েছিল টিপু সুলতান। ভেবেছিল তার খোঁজ আর কেউ পাবে না। পরে শিশুটি গড়াগড়ি করতে করতে এক পর্যায়ে খাট ও দেয়ালের ফাঁকা জায়গায় পড়ে মাথাটা আটকে থাকে। সেদিন রাত ১০টার দিকে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানালা খুলে দেখতে পায় নারীর লাশ পড়ে আছে খাটে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ গিয়ে রিনার লাশ ও প্রিয়াকে উদ্ধার করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশুটির চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ হত্যার ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে টিপু সুলতান। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর