বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী বেশে ডাকাতি

বারবার কারাভোগেও থামেনি কার্যক্রম, রাঙাপরী জুয়েলার্সে লুটে গ্রেফতার ৩

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী বেশে ডাকাতি

ডাকাতির জন্য ওরা ছদ্মবেশ ধারণ করত। কখনো নিরাপত্তাকর্মী কখনো বা পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা সুইপার। টার্গেট করা দোকানে যোগ দিয়েই মার্কেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থার খুঁটিনাটি যেনে নিত। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনে মার্কেটের দোকানও ভাড়া নিত ওরা। মিশন বাস্তবায়নের পর ওরা চলে যেত আত্মগোপনে। কিছুদিন পর একই কায়দায় নতুন কোনো মার্কেটে আস্তানা গাড়ত। এভাবে একযুগ ধরে ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণের দোকান লুটে নিচ্ছিল ওরা। বারবার কারাভোগেও থামেনি তাদের কার্যক্রম।

সবশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি তারা রাজধানীর কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা টাওয়ারের নিচতলায় রাঙাপরী জুয়েলার্স নামে সোনার দোকান থেকে প্রায় ৩০০ ভরি সোনা লুটে নেয়। পরে এ ঘটনা তদন্তে নেমে চক্রের মূলহোতা রাজা মিয়াসহ (৫৪) তার দুই সহযোগী কাউসার হোসেন ওরফে বাচ্চু মাস্টার (৪২) ও মাসুদ খানকে (৪২) গ্রেফতার করে র‌্যাব।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল দুপুরে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত সোমবার গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মুন্সীগঞ্জ ও বরিশাল জেলা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৯ দশমিক ৭০ গ্রাম সোনা ও নগদ ৩ লাখ ২৯ হাজার ১৮০ টাকা উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা রাঙাপরী জুয়েলার্সে সোনা ডাকাতির কথা স্বীকার করেছে। গ্রেফতাররা সংঘবদ্ধ ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের সক্রিয় সদস্য। তাদের টিম লিডার রাজা মিয়া। সে নিজে একজন দক্ষ তালা ভাঙার মেকার, বাকিরাও বিভিন্ন বিষয়ে অত্যন্ত পারদর্শী।

র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, রাঙাপরী জুয়েলার্সে লুটের দেড় মাস আগে রজনীগন্ধা মার্কেটে ভুয়া পরিচয়ে একটি দোকান ভাড়া নেয় চক্রের সদস্যরা। ওই দোকানে নাম সর্বস্ব মালামাল রেখে কৌশলে চুরির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি মজুদ করে। লুট চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার রাজা মিয়া ও তার সহযোগী কাউসার মাস্টারসহ অজ্ঞাত আরও তিন থেকে পাঁচ সদস্য ঘটনার দিন রাত ১২টায় মিরপুর-১৪ নম্বর গোলচত্বরে একত্রিত হয়। গ্রেফতার মাসুদ তাদের রাত ১টা নাগাদ রজনীগন্ধা মার্কেটে আসতে বলে। এ সময়ের মধ্যে মাসুদ মার্কেটের অন্য নিরাপত্তাকর্মীদের কৌশলে খাবার ও পানীয়ের সঙ্গে চেতনানাশক সেবন করিয়ে তাদের অজ্ঞান করে। পরিকল্পনা মতে অন্যরা মার্কেটের সামনে এলে মাসুদ ও তার এক সহযোগী গেটের তালা খুলে তাদের আগেই ভাড়া করা দোকানের ভিতর নিয়ে যায়। কাউসার মাস্টার ও তার এক সহযোগী মার্কেটের বাইরের চারপাশ নজরদারিতে থাকে। পরে রাত ২টার দিকে কাউসার মাস্টারের দোকান থেকে আগে থেকে মজুদ করে রাখা তালা ভাঙার যন্ত্রপাতি দিয়ে দুটি দোকানের তালা এবং শার্টার ভেঙে রাজা মিয়াসহ আরও দু-তিনজন দোকানের ভিতরে যায়। দোকানের ভিতর থাকা স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে তাদের ভাড়া করা দোকানে নিয়ে যায়। ঘটনা চলাকালীন মাসুদ দোকানের বাইরে পাহারা দেয়। দোকানে যে স্বর্ণালঙ্কার লুট হয়েছে তা যেন আগে থেকে না বোঝা যায় সে জন্য তারা দোকানে নতুন তালা লাগিয়ে দেয়। অতঃপর ভোরে লুট করা মালামালসহ কেরানীগঞ্জে কাউসার মাস্টারের ভাড়া করা বাসায় চলে যায়।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানায়, ঘটনার দিন সকালেই তারা লুট করা স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে তাদের গ্রামের বাড়ি চলে যায়। গ্রেফতাররা খুব সাধারণ বেশভূষা ধারণ করে চলাফেরা করত, যেন কেউ তাদের কোনো প্রকার সন্দেহ না করে। গ্রেফতার কাউসার মাস্টার ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রাজধানীর মিরপুরের একটি সিকিউরিটি এজেন্সির নাম ব্যবহার করে মাসুদকে রজনীগন্ধা মার্কেটে সিকিউরিটি গার্ডে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই তারা বিভিন্ন সময়ে মার্কেটের সিকিউরিটিসহ অন্যান্য বিষয়ে খোঁজখবর নিতে থাকে এবং সোনার দোকান লুটের পরিকল্পনা করতে থাকে। রাজা মিয়া তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাউসারের ভাড়া দোকানে নাম সর্বস্ব মালামাল রেখে কৌশলে লুটের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম মজুদ করে।

খন্দকার মঈন বলেন, এ চক্রের সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন। কচুক্ষেতের রাঙাপরী জুয়েলার্সে সোনা ডাকাতির আগেও চক্রটি ২০১৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের জয়পুরহাট শাখার ভল্ট ভেঙে ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা লুট করে। এ ঘটনায় তারা ব্যাংকের পাশের একটি ঘর একটি এনজিওর নামে মিথ্যা পরিচয়ে ভাড়া নেয়। ভল্ট লুটের এক সপ্তাহ আগে থেকে স্ক্রু ড্রাইভার ও শাবল দিয়ে দেয়াল কেটে ব্যাংকের ভল্টে ঢুকে টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। পরে র‌্যাবের অভিযানে রাজা মিয়াসহ সাতজন গ্রেফতার হয়। রাজা মিয়া তিন বছর কারাভোগ করে। একইভাবে তারা ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে দুটি সোনার দোকানে ডাকাতি করে ৪৫৫ ভরি সোনা ও ২ লাখ টাকা লুট করে। পরে র‌্যাবের অভিযানে রাজাসহ চক্রের তিন জন গ্রেফতার হয় এবং কারাভোগ করে। এরপর ২০২০ সালে ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজায় সোনার দোকানে ডাকাতি করে ২৩০ ভরি সোনা ও দেড় লাখ টাকা লুট করে। ওই ঘটনার আনুমানিক দুই মাস আগে এ চক্রের তিন সদস্য মিথ্যা পরিচয়ে একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির গার্ড হিসেবে মার্কেটের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে যোগ দেয়। এতদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছ থেকে তারা গ্রেফতার এড়িয়ে ছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর