বুধবার, ১৮ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

শব্দে জব্দ নাগরিক জীবন

নীরব এলাকায়ও উচ্চ শব্দে হর্ন, পরিবেশ অধিদফতরের অভিযান

শামীম আহমেদ

শব্দে জব্দ নাগরিক জীবন

শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালে কর্মরত একজন প্রকৌশলী সম্প্রতি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের একটি ভবনে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া পুত্রের স্কুলের দূরত্ব কাছাকাছি হওয়ায় তিনি ওই বাসাটি ভাড়া নেন। তার ছিল এক বছর বয়সী আরেকটি শিশু সন্তান। এক মাস শেষ হওয়ার আগেই তিনি বাড়িওয়ালাকে নোটিস দিয়ে বাসাটি ছেড়ে দেন। নোটিসে উল্লেখ করেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে বাসা ছাড়ছেন’। ওই প্রকৌশলীর অভিযোগ, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গাড়ির হর্নের কারণে বড় ছেলে পড়তে পারে না। ছোট সন্তান গাড়ির হর্নের শব্দে বারবার ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে। কান্নাকাটি করে।

নামে উত্তরা একটি ‘মডেল টাউন’। কাগজে-কলমে পরিকল্পিত এই আবাসিক এলাকারই এমন চিত্র। শুধু উত্তরার ওই সড়কটি নয়, ভয়াবহ শব্দদূষণের কবলে পুরো রাজধানী। বাদ যায়নি নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হাসপাতাল এলাকাও। সম্প্রতি ধানমন্ডি এলাকায় বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে ১৭টি স্থানে জরিপ চালিয়ে সব জায়গাতেই বিপজ্জনক মাত্রার (৮১ ডেসিবলের বেশি) শব্দদূষণ পেয়েছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। অথচ, আবাসিক এলাকাতেই অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। হাসপাতালের আশপাশে হর্ন বাজানোই নিষিদ্ধ। চলতি বছর জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি-ইউএনইপি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শিকার ঢাকার বাসিন্দারা। আর শব্দদূষণের প্রভাবে নানারকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যার শিকার এই নগরীর মানুষ। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শব্দদূষণের প্রভাব ভয়াবহ। প্রথমত বধিরতা দেখা দেয়। এ ছাড়া খিটখিটে মেজাজ, মাথা ধরা, হৃৎকম্প, হৃদরোগ, পেটের আলসার, অনিদ্রা, শিশুদের লেখাপড়ায় মনোযোগ কমে যাওয়া ও মানসিক বিকাশ বিঘ্নিত হওয়াসহ শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যার জন্য দায়ী শব্দদূষণ।

ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের ওপর বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ (ক্যাপস) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দদূষণের কারণে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ কম শোনেন। ১৯ দশমিক ১ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, ঘরের অন্য সদস্যদের তুলনায় বেশি ভলিউম দিয়ে তাদের টিভি দেখতে হয়। আর ৩৩ দশমিক ৯ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, অন্যরা উচ্চৈঃস্বরে কথা না বললে তাদের কথা শুনতে কষ্ট হয়। ৮ দশমিক ২ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর তারা ঘূর্ণিরোগ, মাথা ভনভন করা, বমি বমি ভাব ও ক্লান্তির সমস্যায় ভোগেন। ২০২০ সালে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশে শব্দের যে সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা আছে, গাড়ির হর্ন আমদানি করা হয় তার চেয়ে বেশি মাত্রায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডিবি (ডেসিবেল) এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডিবি। সেখানে গাড়ির হর্ন আমদানির মাত্রা দেওয়া আছে ৮০ থেকে ৮৫ ডেসিবল, মোটরসাইকেলে তা ১০০ ডেসিবলের ওপরে চলে যায়। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএ-কে সঙ্গে নিয়ে গতকাল থেকে রাজধানীতে দুই দিনব্যাপী বিশেষ অভিযান শুরু করেছে পরিবেশ অধিদফতর। গতকাল গুলশান-১ নম্বরে বিভিন্ন গাড়ি-মোটরসাইকেল আটকে হর্ন পরীক্ষা করে শব্দের মাত্রা ১০২ ডেসিবল পর্যন্ত পাওয়া যায়। এসব গাড়ির হর্ন খুলে রাখাসহ জরিমানা করা হয়। শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় বাংলাদেশে ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরকে নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা- এই পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। এলাকাভেদে বেঁধে দেওয়া হয় শব্দের মাত্রা। আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে গাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ২০০৬ সালে করা হয় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা। তাতে বলা হয়, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আইনটি কাগজে থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ না থাকায় শব্দদূষণ ক্রমেই বেড়েছে। চলতি বছর জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি প্রকাশিত ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডিবি, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। শব্দদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে গাড়ির হর্নকেই দায়ী করা হয় প্রতিবেদনে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর