শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে শিশুদের ডায়াবেটিস

প্রতি বছর নতুন করে ৪০০-৫০০ শিশু আক্রান্ত

জয়শ্রী ভাদুড়ী

টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাবিহা শবনম। তিন বছর বয়স থেকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয় সাবিহার। রোগের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তার মা-বাবা। কিন্তু একটা সমাধান হলে নতুন সমস্যা শুরু হয়। এক সময় ঘন ঘন প্রস্রাব করতে যাওয়ার বিষয়টি নজরে আসে সাবিহার মা সাঈদা বেগমের।

উপজেলার এক চিকিৎসকের পরামর্শে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে নিয়ে আসেন সাবিহাকে। সাঈদা বেগম বলেন, ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সাবিহা। তখন তার বয়স ছয় বছর। সেই থেকেই চলছে তার চিকিৎসা। সাবিহার ডায়াবেটিসের মাত্রা ওঠানামা করে। দিনে কয়েকবার রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। নিয়ম করে চারবার ইনসুলিন নিতে হয়। এ ছাড়া অন্য ওষুধ তো আছেই। এই বয়সে ডায়াবেটিস শুনে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। স্কুলে অন্য ছেলেমেয়েরা শোনার পর মেয়েকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত। পরে শিক্ষকদের সহায়তায় সেসব সমাধান হয়েছে। এখন চিকিৎসকের পরামর্শে মেয়ে ভালোই আছে, সুস্থ আছে।’

রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে সর্বোচ্চ ১৬ বছরের ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৮ হাজারের বেশি। প্রতি বছর নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা চার শ থেকে পাঁচ শ করে বাড়ছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৭ হাজার বেশি শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ৮২ শতাংশ টাইপ-১ এবং ১৮ শতাংশ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ঢাকা এভারকেয়ার হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট শিশু ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ ডা. ফাহমিদা জাবীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডায়াবেটিস কেবল বড়দের রোগ নয়। বিশ্বে ১ দশমিক ২ মিলিয়নের বেশি শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিশু এই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। শিশুরা মূলত টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। তবে বড়দের মতো শিশুদের মাঝেও টাইপ-২ ডায়াবেটিস আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে যাদের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, অপর্যাপ্ত ব্যয়াম ও শরীরচর্চা, যেসব শিশু-কিশোর মুটিয়ে গেছে, স্থূলতায় ভুগছে তারা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া নবজাতকও অনেক সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। ইনসুলিন হরমোনের ঘাটতি অথবা কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে বংশগত জীনের সম্পৃক্ততা থাকলে, পরিবেশগত কারণে শিশুর ডায়াবেটিস হতে পারে। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে নিয়মিত রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা ও ইনসুলিনের ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ানোর ওষুধের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে চোখ, কিডনি, রক্তচাপ, স্নায়ুজনিত জটিলতায় ভুগতে হয় রোগীকে। এ জন্য নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা জরুরি। যেহেতু এটি সারা জীবনের রোগ তাই নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা, পরিমিত খাবার এবং পর্যাপ্ত ব্যায়াম জরুরি। সার্বিক বিষয় খেয়াল রাখার জন্য অবশ্যই ডায়াবেটিস রোগীকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।’ ময়মনসিংহের তামিম আহমেদ এলাকার একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। সাত বছর বয়সে তার টাইপ-১ ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়। তার বাবা আখতার আহমেদ বলেন, ‘প্রতিদিন তিনবার নির্দিষ্ট সময়ে ইনসুলিন নিতে হয় তামিমের। চার বছর ধরে ইনসুলিন নিয়েই সুস্থ রয়েছে। স্কুলে পড়াশোনা করছে, খেলাধুলা করছে। তাকে নিয়মের মধ্যে রাখছি। ফাস্টফুড থেকে দূরে রাখতে খুব মুশকিল হয়। স্কুলে ওর অন্য বন্ধুদের খাওয়া দেখে ছেলেও খেতে চায়। ওর শিশু মনে তো আর অসুস্থতার রেশ লাগানো যায় না। প্রথমদিকে ডায়াবেটিস শোনার পরে তামিম বাইরে যেতে চাইত না। বলতো সবাই ওকে নানা রকম কথা শোনায়। চিকিৎসকরা ওর ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সিলিংও করেছে। আমরাও ওর বন্ধুদের বুঝিয়ে বলেছি। এখন আমার ছেলে ভালো আছে।’

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর জন্মের পর প্রথম তিন মাস বুকের দুধের পরিবর্তে গরুর দুধ খাওয়ালে শিশুর টাইপ-১ ডায়াবেটিস হওয়ার শঙ্কা থাকে। দ্রুত শিশুর টাইপ-১ ডায়াবেটিস শনাক্ত করতে না পারলে শিশুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয় অনেক সময় মারাও যেতে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের বারবার প্রস্রাব লাগা, ওজন কমে যাওয়া, পিপাসা পাওয়া, খিদে পাওয়া, দুর্বল বোধ করা, কোনো কাজে মন না বসা; এই ছয়টি লক্ষণ থাকলে প্রাথমিকভাবে বোঝা যায় শিশুর ডায়াবেটিস হয়েছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ‘যদি কোনো শিশুর বারবার পিপাসা ও মূত্রত্যাগ হয় এবং হঠাৎ করেই ওজন কমে যায়, এটি ডায়াবেটিসের লক্ষণ। শিশুর এক বছর বয়সের পর যে কোনো সময়ই এটি ঘটতে পারে এবং এসব ক্ষেত্রে বাবা-মা ও অভিভাবকদের দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডায়াবেটিস নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। রোগটি নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ হচ্ছে জীবনা-যাপনের রীতি বদলে ফেলা। জীবন-যাপন নিয়ন্ত্রণে এনে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের পক্ষেও স্বাস্থ্যকর ও স্বাভাবিক জীবন-যাপন সম্ভব। এ জন্য আমাদের সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।’

সর্বশেষ খবর