বুধবার, ২৫ মে, ২০২২ ০০:০০ টা
সরকারকে এফবিসিসিআইর চিঠি

এই দুঃসময়ে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, হুমকিতে অর্থনীতি

অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ না করে গ্যাস-বিদ্যুতের ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রস্তাব সমীচীন নয় : মো. জসিম উদ্দিন

রুহুল আমিন রাসেল

কভিড মহামারি ও ইউক্রেন সংকটে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, উৎপাদন উপকরণসহ সব খাতের মূল্য ব্যাপক বেড়েছে। মুদ্রাবিনিময় হার অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসার খরচ বেড়েই চলেছে। শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক চাপ পড়ছে। বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং খাতের অর্থপ্রবাহে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ দুঃসময়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতির কারণে বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হবে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিঘ্নিত হবে ও সরকারের জাতীয় কর্মসূচি হুমকির মুখে পড়বে বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাস্তবতা মেনে নিয়ে জনজীবনের ওপর অর্থনৈতিক প্রভাব পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ না করে গ্যাস ও বিদ্যুতের ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনা করা সমীচীন হবে না। এফবিসিসিআই সব উৎপাদনশীল খাতের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে মূল্যবৃদ্ধির কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করার দাবি করছে। এফবিসিসিআইর প্রস্তাব কার্যকর হলে সাধারণ মানুষের স্বস্তির পাশাপাশি শিল্প খাতের সক্ষমতা সমুন্নত থাকবে। সার্বিক অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে।’

এর আগে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউসকে গতকাল পৃথক তিনটি পত্র দিয়েছে এফবিসিসিআই। ওই পত্রে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব আপাতত স্থগিত রাখার দাবি জানিয়ে এফবিসিসিআই বলেছে, উৎপাদন খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি খাতে বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বৈশি^ক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যাপকহারে চাকরিচ্যুতি ও বেকারত্ব বেড়ে যাবে। পত্রে এফবিসিসিআই বলেছে, ইতোমধ্যে ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক চাপ পড়ছে। সঞ্চয়ও কমে গেছে। ব্যবসা পরিচালনার খরচ আরও বেড়ে যাবে, কৃষি, শিল্প, সেবা, রপ্তানি খাতসহ সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলমান ধারা বিঘ্নিত হবে, রূপকল্প-২০৪১, এসডিজি-২০৩০ অর্জন ও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন হুমকির মুখে পড়বে। এফবিসিসিআই বলেছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পর্যালোচনা করলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, জ্বালানি খাতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩-এর ২২, ৩১ ও ৩৪ ধারায় নির্দেশিত আবশ্যকীয় শর্তাবলি ও ব্যবস্থাবলি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিরাজমান দুর্বলতার দায়ভার জাতীয় অর্থনীতি এবং জনগণের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে আরোপিত হলে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সুলভ ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।

এফবিসিসিআই গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে ১২ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে- এক. বর্তমান আপৎকালীন সব খাতে গ্যাসের বিদ্যমান মূল্যহার অপরিবর্তিত রাখা। দুই. দেশের গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৭৮ শতাংশ দেশি উৎস থেকে উৎপাদন হয় এবং অবশিষ্ট পরিমাণ আমদানি করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমদানি পর্যায়ে ভর্তুকি দিয়ে প্রস্তাবিত মূল্য বৃদ্ধি না করা। দেশি উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে অনশোর ও অফশোরে নিয়মিত কূপ খনন প্রকল্প গ্রহণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। তিন. সকল প্রকার অপচয়, অবৈধ সংযোগসহ যাবতীয় দুর্বলতা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে নিরসন। বিদ্যুৎ খাত : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সুলভ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। এ প্রেক্ষাপটে এফবিসিসিআইর সুপারিশসমূহ নিম্নরূপ-

চার. বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতের পরিচালন দক্ষতা, ন্যূনতম ব্যয়, ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, সেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান ও কৌশল অনুসরণ এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনার লক্ষ্যে সময়াবদ্ধ সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ।

পাঁচ. এনার্জি সিস্টেম উন্নয়ন পরিকল্পনা যথাযথভাবে অনুসরণ করে ক্যাপাসিটি, ডিমান্ড চার্জসহ মূল্য পরিশোধিত অলস বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল করে অলস বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীকে অর্থ পরিশোধ বন্ধ করা। ছয়. ফার্নেস অয়েলের ওপর মোট কর ৩৪% আরোপিত আছে, কয়লার ওপর ৫% মূসক, গ্যাসের ওপর ডিমান্ড চার্জসহ বিদ্যুৎ বিক্রির ওপর ৬% উৎসে কর ও ৫% উৎসে মূসক আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিপুল হারে অপচয়জনিত ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। এ দ্বিমুখী দায়ভার জনগণসহ দেশের উৎপাদনশীল কার্যক্রমের ওপর পড়ছে। এ অবস্থা নিরসনে ভর্তুকিপ্রাপ্ত জ্বালানি খাতের ওপর শুল্ক ও মূসক প্রত্যাহার করা জরুরি। তবে প্রয়োজনে পরিমাণভিত্তিক ন্যূনতম শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে।

সাত. বিদ্যুতের দৈনিক গড় ব্যবহারের অতিরিক্ত ৩০% রিজার্ভ বিদ্যুতের সংস্থান রেখে অতিরিক্ত উৎপাদন বন্ধ করে খরচ কমিয়ে আনা যেতে পারে। আট. গ্যাস ও কয়লা ভিত্তিক সুদক্ষ ও সুলভ মূল্যে উৎপাদনকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রেখে অদক্ষ ও উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা যেতে পারে। তবে শুধু পিক আওয়ারে ডিজেল প্লান্ট চলতে পারে।

নয়. বর্তমান আপৎকালীন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্প, কৃষি ও অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করে অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ রেশনিং করা। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমে আসবে। সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকে এফবিসিসিআিই স্বাগত ও ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

দশ. জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির (ক্রমান্বয়ে কমে আসছে) কারণে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো সমীচীন নয়। সরকার বিদ্যুৎ খাতের তহবিল থেকে আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে। সরবরাহমূল্য বিদ্যমান হারে বজায় রেখে বাড়তি ব্যয় সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে সমন্বয় করতে পারে।

এগারো. সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য স্থানীয় কয়লার মজুদ যথাযথভাবে কাজে লাগানোর পদক্ষেপ গ্রহণ। বারো. (ক) নেপালের কাঠমান্ডুতে ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন এনার্জি কো-অপারেশন (ইলেকট্রিসিটি) স্বাক্ষরিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বেচ্ছায় এবং সংশ্লিষ্ট সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আইন, বিধি, প্রবিধান ও চুক্তি সাপেক্ষে আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য চালু করা (খ) বিদ্যুৎ উৎপাদন, ট্রান্সমিশন, জ্বালানি দক্ষতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পরামর্শ পরিষেবা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন, ওয়ার্কিং গ্রুপ সম্পর্কিত স্টিয়ারিং কমিটি গঠন এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গ্রিড সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার জন্য ২০১০ সালের পয়লা জানুয়ারিতে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

ওই পত্রে এফবিসিসিআই আরও বলেছে, সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অব এনার্জি কো-অপারেশন (ইলেকট্রিসিটি) ২০১৪ ও ভারত-বাংলাদেশ সমঝোতা স্মারক ২০১০-এর অধীনে আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাজার থেকে সুলভে বিদ্যুৎ ক্রয়-সরবরাহ ব্যবস্থা জোরদার করা এবং জলবিদ্যুৎ খাতে ইইওঘ-ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

এফবিসিসিআই বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস প্রতিটি অর্থনৈতিক সূচকে আমাদের উন্নয়নকে সুদৃঢ় ও বেগবান করেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বের দ্রুততম অগ্রসরমান অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে চলেছে। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেছেন। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির এ সংকটময় পরিস্থিতিতে এ বিশাল অর্জনের জন্য আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

এফবিসিসিআই বলেছে, বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-৭ অনুযায়ী ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ এবং জনগণের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সবার জন্য সুলভ, মানসম্মত, নিরবচ্ছিন্ন এবং টেকসই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের দুর্বলতা ও অপচয় নিরসন করে নিরবচ্ছিন্ন ও সুলভে বিদ্যুৎ সরবরাহের পাশাপাশি এ খাতের টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে এসডিজি-৭ অর্জন করা সম্ভব হবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।

সর্বশেষ খবর