বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

সহসাই কাটছে না লোডশেডিং

বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ, কাল প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বৈঠক

জিন্নাতুন নূর

সহসাই কাটছে না লোডশেডিং

দেশব্যাপী গ্যাস সংকটের কারণে চলমান বিদ্যুতের লোডশেডিং সহসাই কাটছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও জ্বালানির মূল্য না কমা পর্যন্ত দেশব্যাপী বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খোদ বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট উত্তরণে আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতরে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে দায়িত্বশীল সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন। 

এদিকে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্যে গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার মেগাওয়াট। আর বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় ১৩ হাজার ৭০ মেগাওয়াট। এ সময় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল ৯৩০ মেগাওয়াট। বর্তমানে খোলাবাজার থেকে উচ্চমূল্যের জন্য এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় দিনে অন্তত ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি কম সরবরাহ করছে পেট্রোবাংলা। আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে তেল বা কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদনও বাড়ানো যাচ্ছে না।  ঢাকার দুই বিতরণ কোম্পানি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) কর্তৃপক্ষ জানায়, সবমিলিয়ে তাদের ৩০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ ঘাটতি হচ্ছে। আর ঘাটতি মেটাতে এলাকাভেদে ৩০ মিনিট করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।

এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে ঢাকা সেনানিবাসের এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সময় নির্ধারণ করে দেওয়ার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের ব্যাপারে আমাদের শুধু সাশ্রয়ীই হতে হবে না, পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপাদানগুলোও যেন আমরা কম ব্যয় করি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণের দাম অত্যধিক বেড়েছে। অনেক দেশেই বিদ্যুতের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ আমরা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সবাই পাচ্ছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেল, তেল ও এলএনজির দাম বেড়েছে। কয়লা পাওয়া যায় না। একটা সুনির্দিষ্ট সময়ে লোডশেডিং হলে মানুষ প্রস্তুতি নিতে পারবে। কিছু কিছু পদক্ষেপ এখন থেকেই যদি গ্রহণ করি তাহলে আগামীতে যে সমস্যা দেখা দিবে, তা নিজেরাই রক্ষা করতে পারব।’ 

বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বর্তমানে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। আর এই চাহিদা পূরণ করতে আমাদের পর্যাপ্ত উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। যখন আমরা এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেই তখন মূল্য ৫ থেকে ৬ ডলার ছিল। এখন তা ৩৫ থেকে ৪০ ডলারে উঠেছে। এই অবস্থায় উচ্চমূল্যের এই জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ যা হবে তা গ্রাহকদের কাছে সহনশীল হবে না। আবার সরকারকে যদি এ জন্য ভর্তুকি দিতে হয় তাহলে পরোক্ষভাবে খরচটি গ্রাহকের ওপরই পড়বে। বর্তমানে আমাদের যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে সেখান থেকে যদি ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায় তাহলে আর লোডশেডিং করা লাগবে না। কিন্তু আপাতত খোলাবাজার থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ থাকায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এ জন্য বর্তমানে দেড় থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের দুটো পথ। এ জন্য ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। আর এটি করা হলে সহজেই ১ থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে। যে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংকট হবে তা পরিকল্পিতভাবে সুষম বণ্টনের মাধ্যমে লোডশেডিং করা হলে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় বাতি না জ্বালানো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের যথাযথ ব্যবহার ও অফিসে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসেইন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদ্যুৎ সমস্যাটি শুধু আমাদের নয়, এটি বৈশ্বিক। করোনাভাইরাসে পুরো বিশ্ব আক্রান্ত হওয়ার দুই বছর পর পরিস্থিতি যখন কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে এবং মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পায় তখনই জ্বালানির চাহিদা বেড়ে যায়। আর তখন থেকেই জ্বালানির মূল্যও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এরপর জ্বালানির বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন জ্বালানির মূল্য ও সরবরাহ ব্যবস্থা দুটোই টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দুই-তিন দিন ধরে লোডশেডিং দেখতে পারছি। অথচ আমাদের পাশের দেশ যেমন- শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারতে জ¦লানি-বিদ্যুতের অবস্থা আরও খারাপ। শ্রীলঙ্কায় সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানে মোবাইল ফোন বন্ধ করার চিন্তাভাবনা চলছে। তিনি আরও জানান. প্রধানমন্ত্রীর দফতরে আগামীকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক হবে। এখানে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানান, টানা কয়েক দিন চট্টগ্রাম নগরীর প্রতিটি এলাকায় দিন-রাতে বিদ্যুৎ থাকছে না। উপজেলা পর্যায়েও বিদ্যুৎ নিয়ে ভোগান্তিতে রয়েছেন মানুষ। ভয়াবহ এই লোডশেডিংয়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ছাড়াও অফিস-আদালতের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এসব সমস্যার কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকে। লোডশেডিংয়ের পরিমাণ এখন ২০০ থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট। কখনো তা ৪০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের কারণে লোডশেডিং হচ্ছে জানিয়ে পিডিবি চট্টগ্রাম জোনের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, বিদ্যুৎ নিয়ে প্রতিনিয়তই পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। ফলে বর্তমানে কিছু সমস্যা হচ্ছে। কেন্দ্রীয়ভাবে যে নির্দেশনা আসছে আমরা সেভাবেই কাজ করছি।

বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এই মুহূর্তে জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। অথচ চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে যেভাবে লোডশেডিং হচ্ছে, তা আগে দেখিনি। মুরাদপুর এলাকার তাহের আহমদ বলেন, তীব্র গরমে লোডশেডিংয়ের কারণে সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। বিদ্যুৎ আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারও চলে যাচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর