শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

ঢাকায় ডেঙ্গু, পাহাড়ে ম্যালেরিয়া

গতবারের চেয়ে দ্বিগুণ এডিসের লার্ভা, ঝুঁকি বাড়াচ্ছে নির্মাণাধীন ভবনে জমাট বাঁধা পানি, ম্যালেরিয়া ঊর্ধ্বমুখী, দুশ্চিন্তা স্বাস্থ্য বিভাগে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ঢাকায় ডেঙ্গু, পাহাড়ে ম্যালেরিয়া

ঘনবসতির রাজধানী থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ অরণ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মশা। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের ভিড় বাড়ছে হাসপাতালে। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িতে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর মারা গেছেন ১৯ জন, ম্যালেরিয়ায় জুন পর্যন্ত মারা গেছেন ১১ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাহাড়ে বৃষ্টি এবং জুম চাষ বেশি হওয়ায় এ বছর ম্যালেরিয়া রোগী বেড়েছে। বড় একটা জাতিগোষ্ঠী আছে যারা কৌপিন ছাড়া আর কিছুই পরে না। বনে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এ বছর ম্যালেরিয়া রোগী বেড়েছে, মৃত্যুও বেশি। বান্দরবানে ১০ জনের একটি টিম পাঠানো হয়েছিল। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে তারা কাজ করেছেন। আরও একটি টিম পাঠানো হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বর ঘিরেও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্ণয়ে মৌসুমি জরিপ চালানো হয়েছে। সেখানে লার্ভার উপস্থিতি গত বছরের চেয়ে বেশি। এটা সুখকর নয়। দ্রুত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৮ জন। এর মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৭ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৫৪১ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ১৮৫ জন। তার মধ্যে মারা গেছেন ১৯ জন। এ বছর জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১২৬, ফেব্রুয়ারিতে ২০, মার্চে ২০, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৬৩, জুনে ৭৩৭, জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৭১ ও আগস্টে ২ হাজার ৫২৫ জন। জুন থেকে সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুর মৌসুম। আগস্টের শুরু থেকেই বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্ণয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে বছরে তিনটি জরিপ পরিচালিত হয়। গত সপ্তাহে পরিচালিত মৌসুমি জরিপের প্রাথমিক তথ্যে লার্ভার ঘনত্ব গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ পেয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। নির্মাণাধীন ভবনের জমাট বাঁধা পানি এডিস মশার লার্ভার সবচেয়ে বড় উৎসস্থল হয়ে উঠেছে। লার্ভার ঘনত্ব বেশি থাকলে পূর্ণাঙ্গ মশাও বেশি হবে। এতে বাড়বে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস-বাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. একরামুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এডিস মশার মৌসুমি জরিপে আমরা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের ১১০টি স্পটে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩ হাজার ১৫০টি বাড়ি নির্বাচন করি। গত বছর এগুলোর মধ্যে ১৫০টি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। এ বছর প্রায় ৩৫০টি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। গতবারের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক এবং আতঙ্কের খবর। নির্মাণাধীন ভবনের মেঝের পানি মশার বড় উৎসস্থল। একটা স্ত্রী মশা পূর্ণকালীন জীবনে পাঁচবারে ১ হাজার মশার জন্ম দিতে পারে। চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের কাপ, কনটেইনারে প্রচুর লার্ভা পেয়েছি। মশার লার্ভাস্থলের অধিকাংশই মানবসৃষ্ট।’   

রাজধানীর ডেঙ্গুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস-বাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সূত্রে জানা যায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি। এর আগে ২০১৪ সালে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেড়েছিল। ২০১৪ সালে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৪৮০, মারা যান ৪৫ জন। ২০১৫ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯ হাজার ৭১৯, মারা গেছেন নয়জন, ২০১৬ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ২৭ হাজার ৭৩৭, মারা গেছেন ১৭ জন। ২০১৭ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ২৯ হাজার ২৪৭, মারা গেছেন ১৩ জন। ২০১৮ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৫২৩, মারা যান সাতজন। ২০১৯ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ২২৫, মারা গেছেন নয়জন। ২০২০ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ১৩০, মারা গেছেন নয়জন। ২০২১ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ২৯৪, মারা গেছেন নয়জন। এ বছর জুন পর্যন্ত ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৯৯০। এ সময়ে মারা গেছেন ১১ জন। ডা. মো. একরামুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ম্যালেরিয়া রোগীর ৯৪ শতাংশই পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায়। বান্দরবানের থানচি, লামা, আলী কদম- এ তিন উপজেলায় ৭৫ শতাংশ ম্যালেরিয়া রোগী রয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ম্যালেরিয়া রোগী কমেছে ৯৪ শতাংশ, মৃত্যু কমেছে ৯৩ শতাংশ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত করে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ বছর মে-জুনে বান্দরবানের কয়েকটি জায়গায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখতে পাই। প্রকোপ ঠেকাতে অ্যাডভোকেসি করা হচ্ছে, দ্রুত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হচ্ছে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর