শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

জাকির চেয়ারম্যানের প্রতারণার ফাঁদে এমপি পুলিশসহ ৩ শতাধিক মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাকির হোসেনের (৪৩) গাড়ি ব্যবসার ফাঁদে পা দিয়ে হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন এমপি-পুলিশসহ ৩ শতাধিক মানুষ। তিনি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার ২ নম্বর মানিকাচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। প্রতারণার টাকা দিয়ে জাকির নিজে কিনেছেন গাড়ি- আলিশান বাড়ি-জমি এবং ছেলেকে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

বুধবার রাতে মেঘনা উপজেলা থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবি জানায়, জাকির চেয়ারম্যান মূলত কয়েক ধাপে প্রতারণা করেছেন। অন্য কেউ গাড়ি কিনে মাসিক চুক্তিতে তাকে দিত রেন্ট-এ-কার ব্যবসার জন্য। জাকির সেই গাড়ি বিক্রি করে দিতেন, যিনি গাড়ি দিয়েছিলেন তাকে মাসিক চুক্তির টাকাও দিতেন না। আবার স্বল্প মূল্যে গাড়ির মালিকানা হস্তান্তরের লোভ দেখিয়েও হাতিয়ে নিতেন টাকা।

গতকাল বেলা ১২টায় রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এ সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ বলেন, রেন্ট-এ-কারের ব্যবসার আড়ালে ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন জাকির চেয়ারম্যান। গত কয়েক দিনে ডিবি অফিসে দুই শতাধিক ভুক্তভোগী ভিড় করেছেন। আমরা তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারলাম, তার প্রতারণার শিকার হয়েছেন মুন্সীগঞ্জের একটি গ্রামেরই ১৫০ জন মানুষ। তিনি দুই-তিন প্রক্রিয়ায় প্রতারণা করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার গাড়ি রয়েছে ২০-২৫টা। সেসব গাড়ি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সবাইকে দেখাতেন। তিনি কয়েকজন এমপি, প্রশাসনের লোকদের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন। তবে তাদের কাছে ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জন্য মাসিক কিস্তির টাকা ঠিকই মাসে মাসে পরিশোধ করেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তিতে ও মুগদা থানায় এক ভুক্তভোগীর করা মামলার প্রেক্ষিতে ডিবির তেজগাঁও বিভাগ বিশেষ অভিযান চালিয়ে জাকিরকে গ্রেফতার করে। 

হারুন-অর-রশিদ বলেন, আমরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি- তিনি গ্রামের বাড়িতে প্রতারণার সেই টাকায় আলিশান বাড়ি করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেতে কাউকে প্রাডো গাড়ি কিনে দিয়েছেন, নির্বাচনে বিপুল টাকা খরচ করে চেয়ারম্যান হয়েছেন। ঢাকা শহরে তিনি গাড়ি-ফ্ল্যাট-প্লট করেছেন। প্রতারণার টাকায় তিনি নিজের ছেলেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন। আগামী নভেম্বরে তারও যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি। আমরা রিমান্ডে এনে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করব। ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরতের চেষ্টা করা হবে। তার সম্পদ জব্দের জন্য প্রয়োজনে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) মামলা হস্তান্তর করা হবে।

তিনি বলেন, জাকির চেয়ারম্যান পোর্ট থেকে স্বল্প দামে গাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা নিত। একই রেজিস্ট্রেশন নম্বরের গাড়ি একাধিক জাল দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করেন। এ ছাড়াও আগের বিক্রয় করা গাড়ি স্বল্প মূল্যে মালিকানা হস্তান্তরের লোভ দেখিয়ে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। আবার ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পুরো টাকা নিয়ে ডাউন পেমেন্টে গাড়ি কিনতেন। আবার ব্যাংক থেকে গাড়ির বিপরীতে ক্রেতাকে না জানিয়ে ব্যাংক থেকে লোন নিতেন।

ঢাকায় বাস চালকের সহকারী, গাড়িচালক থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বনে যাওয়া জাকিরের দ্বারা প্রতারিত হওয়াদের মধ্যে একজন মুন্সীগঞ্জের সায়েম। ১৫ লাখ টাকায় দোকান বিক্রি করে সেই টাকায় গাড়ি কিনে জাকিরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সায়েম। চুক্তি ছিল এই গাড়ি ভাড়া খাটিয়ে মাসিক ৭০ হাজার টাকা দেবেন জাকির। টাকার জন্য চাপ দিলে সাড়ে ৭ লাখ টাকার একটা চেক ধরিয়ে দেয় তাকে। বাকি টাকা চাইলে মামলার হুমকি দেয়।

সংবাদ সম্মেলনের পর সাংবাদিকদের সায়েম বলেন, এক বছর ভাড়া দেয়নি জাকির। টাকার জন্য চাপ দিলে সাড়ে ৭ লাখ টাকার একটা চেক ধরিয়ে দেয় আমাকে। বাকি টাকা চাইলে মামলার হুমকি দেয়। পুলিশ প্রশাসন ও কয়েকজন সংসদ সদস্যও এই জাকির চেয়ারম্যানের ক্লায়েন্ট। তাদের দেখেই আমরা সাধারণ মানুষ আস্থার সঙ্গে রেন্ট এ কার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলাম।

সায়েমের মতো প্রতারণার শিকার মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি এলাকার সোহেল মোল্লা। তিনি বলেন, পুলিশের অনেক এসআই, ওসিকে দেখে আমি আস্থা পাই। বেশি মুনাফার লোভে সেখানে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দুটি গাড়ি কিনি। গাড়ি কেনার পর কয়েক দফায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা আমি পেয়েছি। বাকি টাকা আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে আর দেয়নি। 

 

সর্বশেষ খবর