শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পোষাতে পদক্ষেপ নেই

বাড়েনি শিক্ষাবছর, ৮৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী টিউটরের শরণাপন্ন কোনো গাইডলাইন আছে কি না জানেন না শিক্ষা কর্মকর্তারা

আকতারুজ্জামান

শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পোষাতে পদক্ষেপ নেই

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে টানা দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীদের শিখন দক্ষতায় অনেক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু স্কুল খোলার পর এ ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাবছর বৃদ্ধি, শিক্ষা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনাসহ কোনো পদক্ষেপ নিতেও উদ্যোগী ভূমিকা দেখা যায়নি। করোনার পর কীভাবে শিক্ষার পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে এ ব্যাপারে শিক্ষকদের জন্য কোনো গাইডলাইন বা নির্দেশিকা রয়েছে কি না তা-ও জানেন না শিক্ষা কর্মকর্তারা। ‘কভিড-১৯-পরবর্তী শিক্ষা পুনরুদ্ধার ও আগামীর ভাবনা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহযোগিতায় গণসাক্ষরতা অভিযান গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও মতামত নেওয়া হয় প্রতিবেদন তৈরিতে।

প্রতিবেদনে বলা হয়- মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৪ শতাংশ অভিভাবক সন্তানের শিখন ঘাটতির জন্য প্রাইভেট টিউটর নিয়োগ দিয়েছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮০ শতাংশ অভিভাবক এ টিউটর রেখেছেন। অনেক শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হয়েছেন। এতে আরও বলা হয়, ৪৭ শতাংশ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শিখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৮ শতাংশ ও প্রাথমিকের ৮৫ শতাংশ শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতির মূল্যায়ন এবং এ সংকট কাটিয়ে উঠতে তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশিকা বা গাইডলাইন নেই বলে জানিয়েছেন। শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশিকা রয়েছে কি না- এ ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারেননি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯০ শতাংশ কর্মকর্তা। প্রতিবেদন বলছে, শিখন ক্ষতির মূল্যায়ন ও পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষকে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে দেখা যায়নি।

তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিখন ঘাটতি পূরণে কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি বিষয়টি ঠিক নয়। আসলে স্কুলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কারণ একেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর ঘাটতি একেক রকম। গ্রাম এলাকার শিক্ষার্থীদের ঘাটতি আর শহর এলাকার ঘাটতি এক নয়। জেলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের ঘাটতি আর উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ঘাটতিও এক হবে না। যেখানে যে স্কুলে যেমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার শিক্ষকরা তেমনই ব্যবস্থা নিচ্ছেন।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- প্রাথমিক পর্যায়ের ৫৩ ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪৪ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষার ক্ষতি পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম দুই থেকে তিন বছর বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। কেউ কেউ এ কার্যক্রম তিন থেকে চার বছর চালিয়ে নিতে বলেছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের ছাত্রছাত্রীর এক-তৃতীয়াংশের বেশি অভিভাবক শিক্ষা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম দুই থেকে তিন বছর মেয়াদি করার পরামর্শ দিয়েছেন। দুই-তৃতীয়াংশ উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও শিখন পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের মেয়াদ তিন থেকে চার বছর করার পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাবছর বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে নিয়মিত ক্লাসের মাধ্যমে কীভাবে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘করোনায় শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। কী কী ক্ষতি হয়েছে তা পরিমাপ করতে একটি শিক্ষাশুমারি করার প্রয়োজন ছিল, তা-ও করা হয়নি। শিখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার বাজেটেও কোনো বরাদ্দ রাখেনি।’

শিক্ষার্থীদের ঘাটতি কমিয়ে আনতে ছাত্রছাত্রীদের শিখন দক্ষতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ প্রস্তাব করেছে এ প্রতিবেদন। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- স্কুল খোলা রাখা, পড়াশোনার পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বা স্কুল ক্যালেন্ডার পুনর্বিবেচনা, মৌলিক দক্ষতার ওপর মনোযোগ দেওয়া, স্কুলে খাবার কার্যক্রমের সম্প্রসারণ, পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার জন্য অর্থায়ন করা। প্রতিবেদনে বলা হয়- করোনার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও বস্তি এলাকার ১৪ শতাংশ শিশু স্কুলে ফেরেনি। অনেক শিশু ও কিশোর-কিশোরী এখন স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপসহ প্রযুক্তিগত বিভিন্ন ডিভাইসে প্রভাবিত। কভিড-১৯ মহামারি এ প্রবণতা আরও বৃদ্ধি করেছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১৯ শতাংশ অভিভাবক বলছেন, তাঁদের সন্তানরা স্মার্টফোন, কম্পিউটারে আসক্ত। বস্তি এলাকার ২৮ শতাংশ অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের এমন আসক্তির কথা জানিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর