সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

মেয়াদ পেরিয়েও শেষ হয় না প্রকল্প

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

মেয়াদ পেরিয়েও শেষ হয় না প্রকল্প

চলতি বছরের জুনে মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রকল্পটির। এ সময়ের মধ্যে ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৪৪ শতাংশ; অর্থাৎ অর্ধেকেরও কম। ২০১৮ সালে যখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়, তখন এর প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২০১ কোটি টাকা। পরের বছর সংশোধনী এনে মোট ব্যয় ১ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে আবারও একনেকে তোলা হয়। সংশোধিত প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ শেষে এখন দেখা যাচ্ছে, সাকুল্যে খরচ হয়েছে ৬৫৫ কোটি টাকা। এটি প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয়ের ৪০ শতাংশ মাত্র।

মুন্সীগঞ্জে প্রস্তাবিত বিসিক কেমিক্যাল শিল্প পার্কের বাস্তব চিত্র এটি। পরিকল্পনা কমিশনে গত ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পিইসি (প্রজেক্ট ইভালুয়েশন কমিটি) সভায় প্রকল্পটির এই চিত্র উঠে আসে। সময়মতো বাস্তবায়ন কাজ শেষ করতে না পারায় পিইসি সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নিয়মবহির্ভূত ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবের জন্য বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-কে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি)-তে ৩৬২টি প্রকল্প ছিল যেগুলো এ বছরের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। গত ২ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় (এনইসি) এই প্রকল্পগুলোর মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এই প্রকল্পগুলোর বিষয়ে ২৪ মার্চ একটি পরিপত্র জারি করে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ। ওই পরিপত্রে বলা হয়, সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত এসব (৩৬২টি) প্রকল্প জুন, ২০২২-এর মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে এবং এসব প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানো যাবে না। এনইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ানার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগুলোকে নির্দেশনাও দেওয়া হয় পরিপত্রে। মেয়াদ না বাড়ানোর তালিকায় থাকা এই ৩৬২টি প্রকল্পের একটি হচ্ছে বিসিক  কেমিক্যাল শিল্প পার্ক, যার মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর পিইসির সভা হয়।

পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) খন্দকার আহসান হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত ওই ৩৬২টি প্রকল্পের মধ্যে কিছু প্রকল্প ছিল যেগুলো বন্যাসহ নানা কারণে সমাপ্ত করা যায়নি। ওই প্রকল্পগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে ১৭ মে এনইসি সভায় সিদ্ধান্ত হয়। ওই তালিকায় বিসিকের কেমিক্যাল শিল্প পার্ক থাকলে এর মেয়াদ বাড়াতে বাধা নেই।

সূত্র জানায়, নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পটি শেষ হয়নি, এটিই এ প্রকল্পের একমাত্র দুর্বলতা নয়। মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সময়মতো আবেদনও করা হয়নি। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড় মাস পর নিয়মবহির্ভূতভাবে ভূমি উন্নয়নে আরও ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু প্রকল্প এলাকাটি দুটি নদী ধলেশ্বরী এবং ইছামতির মিলনস্থলে হলেও-এমন একটি স্থানে  কেমিক্যাল শিল্প পার্ক স্থাপনে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও নেওয়া হয়নি।

সভার কার্যবিবরণীতে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের এক কর্মকর্তা সভায় জানান, প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী আলোচ্য প্রকল্পটি ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে জুন, ২০২২- এ সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার প্রায় দেড় মাস পর দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন সংক্রান্ত পরিপত্র অনুসারে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কমপক্ষে তিন মাস আগে সংশোধন প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা প্রতিপালন করা হয়নি। শুধু তাই নয়, প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ভূমি উন্নয়ন ব্যয় ১৩০ কোটি ১৭ লাখ টাকা থেকে ১১০ কোটি ১৩ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ২৪০ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিকে ‘অত্যধিক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে সভায়। পিইসি সভায় উত্থাপিত এসব পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রথমে প্রকল্পটি কেরানীগঞ্জে করার কথা ছিল। প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছিল ওই এলাকার ভূমি ও রাস্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে ১০ ফুট পর্যন্ত মাটি ভরাটের সংস্থান ছিল; কিন্তু পরবর্তীতে প্রকল্পটি মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তরিত হওয়ায় এবং এলাকাটি বন্যাপ্রবণ হওয়ায় জমির দাম কম হলেও ভূমি উন্নয়নের জন্য বন্যার পানির সর্বোচ্চ সীমা ১৭ ফুট পর্যন্ত মাটি ভরাট করতে হচ্ছে। এ কারণে সংশোধনী প্রস্তাবে ভূমি উন্নয়নে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ ছাড়পত্রসহ অন্য বিষয়গুলো নিয়ে প্রকল্প পরিচালক জানান, পিইসি সভায় যেসব পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে সেসব বিষয় সংশোধন করে পুনরায় প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন জানানো হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুনে ১২৩ জন প্রাণ হারানোর ঘটনার পর কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই নির্দেশনার পর বুড়িগঙ্গার তীরে কেরানীগঞ্জে  কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনে প্রকল্প গ্রহণ করে বিসিক। ২০১ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা’ শিরোনামে এ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)-এ অনুমোদিত হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আবারও এক বিভীষিকাময় অগ্নিকান্ডে ৭১ জন প্রাণ হারানোর পর প্রধানমন্ত্রী পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল কারখানা দ্রুত স্থানান্তরে কঠোর নির্দেশনা দেন। এরপর কেরানীগঞ্জ থেকে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তর করে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০১ কোটি টাকার প্রকল্পটির সংশোধনী এনে ১ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে ‘বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, মুন্সীগঞ্জ’ শিরোনামে আবারও একনেকে উপস্থাপন করা হয়। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের চিত্রকোট ইউনিয়নে ৩০৮ একর জমিতে বিসিক  কেমিক্যাল শিল্প পার্ক তৈরির প্রকল্পটি ২০১৯ সালের এপ্রিলে অনুমোদিত হয় একনেকে। এ শিল্প পার্কটির এক পাশে ঢাকা-দোহার সড়ক এবং অপর পাশে ইছামতি নদী।

সর্বশেষ খবর