সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

হঠাৎ কেন উত্তপ্ত চিনির বাজার

♦ পাইকারি বাজারে উধাও লাফিয়ে বাড়ছে খুচরা দাম ♦ চিনি আমদানিতে ঘাটতি নেই : বাংলাদেশ ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও চট্টগ্রাম

হঠাৎ কেন উত্তপ্ত চিনির বাজার

হঠাৎ করেই বাজারে দেখা দিয়েছে চিনি সংকট। পাইকারি বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে পণ্যটি। দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে টাকা দিয়েও মিলছে না চিনি। খুচরা বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে  কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। সরকার খোলা চিনির দাম প্রতি কেজি ৯০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। প্যাকেট চিনি পাওয়াই যাচ্ছে না। জরিমানার ভয়ে অনেক খুচরা বিক্রেতা চিনি বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে দোকান থেকে দোকানে ঘুরে মিলছে না খাদ্যপণ্যটি।

ভোক্তারা বলছেন, কিছুদিন পর পরই এক একটি পণ্য বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। কখনো লবণ, কখনো চাল, আবার কখনো চিনি। এরপরই বাড়ছে দাম। বাজার নজরদারির অভাবে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন অধিকাংশ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী মার্চ-এপ্রিলে শুরু হবে রমজান। চিনির চাহিদা বাড়বে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। এদিকে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে চিনি আমদানিতে কোনো ঘাটতি নেই। শিগগির আরও এক লাখ টন চিনি আমদানি করা হচ্ছে। একটু তদারকি করলে চিনির বাজার স্বাভাবিক হবে বলে আমরা আশাবাদী।’

চলতি মাসের শুরুর দিকে কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়ে প্রতি কেজি পরিশোধিত খোলা চিনি ৯০ টাকা ও পরিশোধিত প্যাকেটজাত চিনির দাম ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তবে এই দাম কার্যকর হয়নি।

গত সপ্তাহের শুরুতেও চিনির দাম কেজিপ্রতি ৯৫ টাকার একটু ওপরে ছিল। বর্তমানে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকায়। প্যাকেটজাত চিনির দাম মোড়কে সরকার নির্ধারিত ৯৫ টাকা লেখা থাকলেও তা বাজারে নেই। অনেকে প্যাকেট খুলে বিক্রি করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ৫০টি বাজারে গত শনিবার বিশেষ অভিযানে নামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। অভিযানে বাজারে চিনিসংকটের সত্যতা মেলে। অভিযান নিয়ে সংস্থাটির পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘আমরা বাজার অভিযানের পাশাপাশি চারটি বড় কোম্পানির ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করেছি। কোনো কোনো ফ্যাক্টরি থেকে গত মাসের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত চিনি বাজারে কম সরবরাহ হয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন।  পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা চাহিদামতো চিনি পাচ্ছেন না। কারওয়ান বাজারে চিনির পাইকারি বিক্রেতা মেসার্স বেঙ্গল অয়েলের স্বত্বাধিকারী মো. মহিউদ্দিন বলেন, আগে যেখানে ১ হাজার বস্তা চিনি পেতাম, এখন পাই ১০০ বস্তা। মিল থেকে বলা হচ্ছে জ্বালানি সংকটে তারা উৎপাদন করতে পারছেন না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় সব জায়গায় দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। আমরাই প্রতি কেজি চিনি পাইকারি কিনছি ১০১ টাকায়। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা কয়েক দিন ধরে পরিবেশকদের কাছে চিনি চেয়েও পাচ্ছেন না। আজ-কাল করে ঘোরাচ্ছেন।

খাতুনগঞ্জে টাকা দিয়েও মিলছে না চিনি : দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকায় টাকা দিয়েও মিলছে না চিনি। চিনির সংকট থাকায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে মণ প্রতি চিনির দাম বেড়েছে সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ টাকা। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ‘চিনির বাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার নিয়ন্ত্রণ কাজ করছে জেলা প্রশাসন। এ বিষয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে আলাপ হয়েছে। রবিবার খাতুনগঞ্জে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা শুরু করেছে জেলা প্রশাসন।’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘সরকার গ্যাসে রেশনিংয়ের কারণে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ কমে এসেছে। তাই চিনির উৎপাদনে ধস নেমেছে। আবার নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার টিসিবির জন্য চিনি সংগ্রহ করছে স্থানীয় বাজার থেকে। ডলারের ঊর্ধ্বগতির কারণেও চিনি আমদানি করতে পারেনি আমদানিকারকরা। এসব কারণে চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তাই চিনির সংকট হয়েছে। সংকটের কারণেই চিনির বাজার ঊর্ধ্বগতি।’ জানা যায়, এক সপ্তাহ আগেও খাতুনগঞ্জে বাজারে চিনির মণ ছিল ৩২শ’ থেকে ৩৩শ’ টাকা। কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রতি মণ চিনির দাম বেড়েছে সাড়ে তিনশ’ টাকা থেকে চারশ টাকা। বর্তমানে আবার নগদ টাকা দিয়েও চাহিদামাফিক মিলছে না চিনি। ডিও কিনে কারখানার গেটে দিনের পর দিন অবস্থানের পর মিলছে চিনি। আগে প্রত্যেক মিল দিনে ২০০ গাড়ি করে চিনি ডেলিভারি দিত। বর্তমানে তারা ৫০ গাড়ির বেশি চিনি সরবরাহ করতে পারছে না। ব্যবসায়ীদের দাবি- চিনির যোগান কমে যাওয়ার কারণেই সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানান  বৈশ্বিক কারণেও চিনি আমদানিতে প্রভাব তৈরি করছে। সরকার টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে বাজারে চিনি বিক্রি করছে। কিন্তু টিসিবি এসব চিনি সংগ্রহ করছে দেশি মিলগুলো থেকে। গ্যাসের সংকট বাদেও ডলার সংকটসহ আমদানিতে শুল্ক বেশি হওয়া চিনির দাম বাড়ার প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। দেশে প্রতি বছর চিনির চাহিদা রয়েছে ২০ লাখ টন। যার মধ্যে সরকারি ১৫ চিনি কল উৎপাদন করে প্রায় ৩০ হাজার টন। তাই বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করা চিনি দিয়ে মেটাতে হয় দেশের চাহিদা। আমদানি করা চিনির মধ্যে প্রায় ২২ লাখ টন চিনি আমদানি করে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। গত বছর অক্টোবরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চিনি ৫৫১ ডলারে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৫১১ ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম না বাড়লেও দেশে হঠাৎ করে ঊর্ধ্বমুখী চিনির বাজার।

সর্বশেষ খবর