মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

চেইনম্যান থেকে প্রতারণার মাস্টারমাইন্ড

কেডিএর চাকরিচ্যুত কর্মচারীর সম্পদের পাহাড়, অভিযোগ দুদকে

সাখাওয়াত কাওসার

চেইনম্যান থেকে প্রতারণার মাস্টারমাইন্ড

কখনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, কখনো রাজউকের অথরাইজড অফিসার, আবার কখনো জাতীয় গৃহায়ণ অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করে বিভিন্ন কাজের জন্য অনেকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ টাকা। অথচ মো. মুজিবুর রহমান নামে এই প্রতারকের মূল পরিচয় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) চাকরিচ্যুত চেইনম্যান। সব শেষ পূর্বাচলে ৬ কাঠার একটি প্লট বিক্রির কথা বলে একই ভবনের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে ৩ কোটি ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। পরে পুলিশকে ম্যানেজ করে সেই ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধেই মিথ্যা মামলা করেন মুজিবুর। মামলার তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের কাছে গেলে উঠে আসে ঘটনার আদ্যোপান্ত। তবে মামলার তদন্তের স্বার্থে পিবিআইর পক্ষ থেকে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চিঠি দিলেও তাতে সাড়া দেননি তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুজিবুর রহমান কেডিএর চেইনম্যান অর্থাৎ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। নানা অনিয়মের দায়ে ২০২০ সালের ২৩ জুন তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই বছর ১২ নভেম্বর তাকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করে কেডিএ। ভুক্তভোগী মোস্তাফিজুর রহমান ধানমন্ডি ১১ নম্বর সড়কের ৭৭ নম্বর কনকর্ড নুসরাত অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা। একই ভবনের দ্বিতীয় তলার ২-এ নম্বর বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন মুজিবুর। এ সুবাদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবেই মুজিবুরকে চিনতেন ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের মালিকরা। সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে তাকে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও মনোনীত করা হয়। কিছুদিন পর ডেপুটেশনে রাজউকে বদলি হয়ে অথরাইজড অফিসার হয়েছেন এমন পরিচয় দেন ভবনের বাসিন্দাদের। এ সময় তিনি পূর্বাচলে একটি ৬ কোটি টাকার প্লট ৪ কোটি টাকায় কিনে দেওয়ার জন্য মোস্তাফিজকে প্রস্তাব দেন। ২ কোটি টাকা লাভ হবে এমন লোভনীয় অফারে সানন্দে রাজি হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই দুই দফায় ক্যাশ ৩ কোটি ৭ লাখ টাকা দিয়ে দেন মোস্তাফিজুর। তবে মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও মুজিবুর তাকে প্লট বুঝিয়ে না দিয়ে চলতি বছর ২২ ফেব্রুয়ারি উল্টো ধানমন্ডি থানায় মোস্তাফিজুরের নামে ৫ কোটি টাকার মামলা করেন। শুরু হয় পুলিশি হয়রানি। আদালতের মাধ্যমে পিবিআইকে মামলার তদন্ত দেওয়া হলে উঠে আসে ঘটনার আদ্যোপান্ত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান মামলাটি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। তবে তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়াকে তলব করে চিঠি দিলেও তাতে সাড়া দেননি তিনি। এ ব্যাপারে পিবিআই কর্মকর্তা তাহেরুল হক চৌহান বলেন, ‘মামলার তদন্তে গিয়ে মুজিবুরের অনেক বিষয় আমরা জানতে পেরেছি। আপনারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করুন। অনেক কিছুই জানতে পারবেন। তবে তার দায়ের করা মামলাটির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।’ ওসিকে তলব করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার স্বাক্ষর করা চিঠি দেওয়া হয়েছিল ধানমন্ডি থানার ওসিকে। তবে তিনি তাতে সাড়া দেননি। এখন মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মোস্তাফিজুরের দায়ের করা মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে।’ ২২ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মুজিবুরের দুর্নীতি ও অঢেল সম্পত্তির বিষয়ে অভিযোগ দেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক উপমহাপরিচালক সেখ আবদুস সালেক। তবে রহস্যজনক কারণে গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গতকাল এ ব্যাপারে অভিযোগদাতা সেখ আবদুস সালেক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কেডিএর একজন পিয়ন কীভাবে এমন অঢেল সম্পদের মালিক হলেন? এসব বিষয় দেখার কি দেশে কেউ নেই!’

পিবিআইর প্রতিবেদনে যা আছে : আদালতে দেওয়া পিবিআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাদী ও বিবাদীর অঙ্গীকারনামার স্ট্যাম্প ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিনতাই হয়। অথচ এ নিয়ে ১০ দিন আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি থানায় জিডি করেন মুজিবুর। ছিনতাইয়ের দুই দিন আগে ২২ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন তিনি। তাহলে কীসের ভিত্তিতে বা কোন দলিলের ভিত্তিতে এ মামলা রুজু হলো তা প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া অঙ্গীকারনামা স্ট্যাম্পে উল্লেখ আছে যে, ১৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জমির প্লট রেজিস্ট্রি ও হস্তান্তর করে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন মুজিবুর, অন্যথায় তিন মাসের মধ্যে পুরো টাকা এককালীন ফেরত দেবেন। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন মোস্তাফিজুর রহমান। যেখানে তিন মাসের কথা বলা হয়েছে, এর পাঁচ দিন আগেই ধানমন্ডি থানায় মামলা রুজু হয়। বিষয়টি অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক বলে প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই। এ ছাড়া ১৬ ও ২১ ফেব্রুয়ারি মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে মারধর ও হুমকি দেওয়ার যে অভিযোগ করেছেন মুজিবুর, এর সত্যতা পায়নি পিবিআই। ‘মামলায় নানারকম অসংগতিসহ অঙ্গীকারনামা দলিলে অসম্পূর্ণ বিষয় থাকা সত্ত্বেও ধানমন্ডি থানার ওসির মামলা গ্রহণ করাটা একেবারেই সমীচীন বলে মনে হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে ওসিকে চিঠি দিয়ে হাজির হতে অনুরোধ করলেও তিনি হাজির হননি’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

এ ব্যাপারে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া বলেন, ‘দুজনই মামলা করেছেন। দুজনের মামলাই নেওয়া হয়েছে। পরে যেহেতু তদন্তভার পিবিআই পেয়েছে, সেহেতু পিবিআই তদন্ত করে সঠিকটা বের করবে।’

মুজিবুরের যত সম্পদ : হাতিরপুল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের পুকুরপাড়ে একটি অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট রয়েছে মুজিবুরের। তবে তিনি সপরিবার ধানমন্ডির ১১/এ নম্বর রোডে ৭৭ নম্বর বাড়িতে বসবাস করেন। ওই ফ্ল্যাটটির ন্যূনতম মূল্য ৪ কোটি টাকা। যাতায়াতের জন্য দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-৩৬-৩০৩৯ ও ঢাকা মেট্রো-গ-২৬-৪৪০৬) ব্যবহার করেন তিনি। দুটি গাড়ির জন্য দুজন চালক রয়েছেন। এ ছাড়া তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসাও রয়েছে। মোহাম্মদিয়া সুপার মার্কেটের ৭৯/৮০ নম্বর দোকানে খোলা হয়েছে কোম্পানির অফিস। এ ছাড়া মুজিবুরের নামে-বেনামে একাধিক প্লট রয়েছে। বিভিন্ন জনকে পূর্বাচলে প্লটে কিনে দেওয়ার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি তিনি। দলিল করে না দেওয়ায় একপর্যায়ে টাকা চাইলে উল্টো ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা জিডি ও মামলা করেন মুজিবুর। টাকার বিনিময়ে স্থানীয় কাউন্সিলর ও থানা পুলিশ তাকে শেল্টার দিচ্ছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। ধানমন্ডি সোসাইটির সদস্যও তিনি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মুজিবুর রহমান বলেন, তিনি মোস্তাফিজুরের কাছে টাকা পাবেন। একসময় রাজউকের সার্ভেয়ার বিভাগে চাকরি করতেন তিনি। চাকরি ছেড়ে বর্তমানে জমির ব্যবসা করছেন। কোনো অনিয়মের অভিযোগে নয়, নিজেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেন মুজিবুর।

 

সর্বশেষ খবর