রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে সর্বস্ব লুট করত চক্রটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশব্যাপী অভিনব কৌশল অবলম্বন করে প্রতারণার ফাঁদ পেতে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করত একটি চক্র। এই চক্রটি বিভিন্ন সময় জমি ক্রয়, ফ্ল্যাট ক্রয়, ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে দেওয়ার নাম করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করত। অভিনব এই প্রতারণা চক্রের মূল হোতাসহ পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগ। তারা হলেন- মো. কবির ওরফে মিজান উকিল, তার পিএস মো. পিন্টু খান, কবিরের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম, কবিরের স্ত্রী কেয়া রহমান ও কবিরের অফিসের রিসিপশনিস্ট সাদিয়া ইসলাম মৌ। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি ব্রিফকেস, একটি লাগেজ, ৩৬টি ১০০০ ও ৫০০ টাকাসদৃশ বান্ডেল এবং ২০টি সিমসহ ১২টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। শুক্রবার রাতে রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ডিবি জানায়, চক্রটির দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪ জন এজেন্ট রয়েছে। তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মানুষদের অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে অভিনব কৌশলে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করা হতো। এই চক্রের প্রধান কবির সর্বনিম্ন ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্গেট করতেন। গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, চক্রটি বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণার ফাঁদ পেতে টাকা আত্মসাৎ করত। তাদের মূল হোতাসহ পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিজেদের শিল্পপতি, সমাজসেবকসহ নানা পরিচয় দিত। বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে ভিন্ন নাম ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করত। চক্রটি নারীদের দিয়ে টার্গেট করা ব্যক্তিকে অভ্যর্থনা প্রদান, বিভিন্ন দামি রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশন করাত। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে টার্গেট ব্যক্তির বিশ্বাস অর্জন করত চক্রটি। প্রতারক চক্রটি প্রতারিত ব্যক্তিদের সামনে একটি নাটক মঞ্চস্থ করত। সেখানে তিন মাসের মধ্যে জুয়া খেলে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা জেতার প্রতারণা করে। অভিযুক্তরা বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করত। কবির নিজেকে শিল্পপতি ও সমাজসেবক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় কারখানা স্থাপন, ক্লিনিক, মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার বানানোর লোভ দেখিয়ে আগত ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করতেন। পিন্টু নিজেকে শিল্পপতির পিএস হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারিত ব্যক্তিদের রিসিভ করতেন এবং কবিরের অফিসে নিয়ে আসতেন। সাইফুল জেলা পর্যায়ে এজেন্ট নিয়োগ করে স্থানীয় ধনী ব্যক্তিদের টার্গেট করে ঢাকায় নিয়ে আসতেন। কেয়া প্রতারণার পরিকল্পনা ও ক্লিনিক ব্যবসার নাটক সাজিয়ে কবিরকে সহায়তা করতেন। আর সাদিয়া অফিস স্টাফ হিসেবে প্রতারিত ব্যক্তিদের আপ্যায়ন ও খাবার পরিবেশন করতেন। তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মানুষকে টার্গেট করে হাতিয়ে নিত মোটা অঙ্কের টাকা। ডিবির ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘গ্রেফতার পাঁচজনকে ডিএমপির উত্তরা পশ্চিম থানায় করা একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গতকাল ওই মামলায় তাদের সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত কবিরের তিন দিন এবং পিন্টু ও সাইফুলের দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ছাড়া কেয়া ও সাদিয়াকে রিমান্ড নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আমরা এই চক্রের কাছ থেকে দুটি ডায়েরি উদ্ধার করেছি। সেখানে কার সঙ্গে কী পরিচয়ে কোন ধরনের প্রতারণা করত তারা তা উল্লেখ রয়েছে। আমরা সেগুলো যাচাই করে দেখছি।’ তিনি বলেন, ‘এসএসসি পাস করা কবির ১০-১২ বছর ধরে প্রতারণা করে আসছেন। তার পাঁচটি বাড়ির সন্ধান পেয়েছি। প্রতারকরা পরস্পর যোগসাজশে ক্লিনিক, মোবাইল টাওয়ার, শিল্প-কারখানা স্থাপন, ব্যবসার নাম করে প্রতারণার মাধ্যমে টার্গেট ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত। টার্গেট ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর তারা অফিস বন্ধ করে দিত। এ ছাড়া ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের মোবাইল ফোন ও সিম নষ্ট করে ফেলত। চক্রটি অভিজাত এলাকায় অফিস ভাড়া নিয়ে প্রতারণা করত। কবিরের বাড়ি শরীয়তপুরের সখিপুর থানার উকিলকান্দিতে।’ জানা গেছে, বগুড়ার মো. লুৎফর রহমান নামে এক ব্যক্তি পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করছিলেন। বাড়ির তৃতীয় তলা পর্যন্ত কাজ শেষ করেছেন। তার ছেলে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসা পেশায় যোগ দিয়েছেন। ভালোই চলছিল দিনকাল। কিন্তু ২০ সেপ্টেম্বর প্রতারক চক্রের এক সদস্য সেখানে ভালো মানের ক্লিনিকের অফার করেন লুৎফরকে। ক্লিনিকে তিনি এবং তার ছেলে চাকরি করবেন বলে জানানো হয়। এ ছাড়া ভালো দেখে লুৎফরকে একটা জমি কিনে দেওয়ার কথাও বলেন প্রতারক চক্রের ওই সদস্য। এরপর তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে লুৎফরের। ২৪ সেপ্টেম্বর লুৎফরকে ঢাকার উত্তরার একটি অফিসে নিয়ে আসেন ওই প্রতারক। সেখানে ক্লিনিকে অধিক মুনাফার কথা বলে লুৎফরকে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগে উৎসাহিত করেন প্রতারকরা। এরপর লুৎফর প্রতারকদের কথায় আকৃষ্ট হয়ে ২৩ অক্টোবর ৫ লাখ টাকা প্রদান করেন। পরে বিভিন্ন ধাপে ৮৫ লাখ টাকা প্রতারকদের হাতে তুলে দেন। ৯০ লাখ টাকার মধ্যে স্বজনদের কাছ থেকে ৮২ লাখ টাকা ধার করে আনেন লুৎফর। এরপর তিনি ঢাকার উত্তরার ওই অফিস বন্ধ পান। লুৎফরের সব স্বপ্ন নিমেষেই অন্ধকারে পরিণত হয়। তিনি বুঝতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পরে ১০ নভেম্বর তিনি ডিএমপির উত্তরা পশ্চিম থানায় প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

সর্বশেষ খবর