সোমবার, ২১ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
সড়ক দুর্ঘটনা

পঙ্গুত্ব বাড়ছে দ্বিগুণ হারে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

পঙ্গুত্ব বাড়ছে দ্বিগুণ হারে

যশোরের মনিরামপুর উপজেলার পশু চিকিৎসক আলী হোসেন (২৭)। বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে পাশের গ্রামে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় নসিমনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে তার বাম পায়ের ওপর মোটরসাইকেলটি পড়ে যায়। থেঁতলে যায় পায়ের মাংস। খুলনায় বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ঢাকায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (নিটোর) আনলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে না আসায় তার বাম পা কেটে ফেলা হয়। দুর্ঘটনার কারণে তরুণ আলী হোসেনের জীবন গ্রাস করেছে পঙ্গুত্ব।

শুধু এই একটি ঘটনা নয়। প্রতিদিন সারা দেশে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সঙ্গে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে পঙ্গুত্বের শিকার মানুষের সংখ্যা। দুর্ঘটনার ক্ষতচিহ্নে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে তাদের জীবন। পরিবারের কর্মক্ষম মানুষ পঙ্গু হয়ে পড়ায় জীবনযুদ্ধে নামতে হচ্ছে অন্য সদস্যদের।

গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে ৬ হাজার ২৮৪ জন নিহত এবং ৭ হাজার ৪৬৮ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৯২৭ জন নারী এবং ৭৩৪ জন শিশু। এ সময়ে ৭৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৫৯ জন মারা গেছেন, ১৯২ জন আহত হয়েছেন এবং ৪৭ জন নিখোঁজ হয়েছেন। গত বছর ১২৩টি রেল দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত এবং ৩৯ জন আহত হয়েছেন। 

গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ২১ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজপোর্টাল ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানিয়েছে। সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৯৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ২৮৬ জন। গত বছর অক্টোবরে যাত্রীকল্যাণ সমিতি এক প্রতিবেদনে জানায়, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করছেন। এর মধ্যে ১৭ বছরের কম বয়সী শিশু ১২ হাজারের বেশি। এ হিসাবে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করছেন কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সংস্থাটির তথ্যমতে, হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। এক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটি দাবি করছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হচ্ছে।’ বুয়েটের এআরআইর হিসাব বলছে, গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এমন ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হলে সড়ককে নিরাপদ করতে হবে। এ জন্য জাতিসংঘ নির্ধারিত নিরাপত্তা কৌশল অনুসরণ করে শক্তিশালী সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে সামনে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১৬ সালে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারায় এবং পঙ্গত্ববরণ করে ৩ লাখেরও বেশি মানুষ। সড়কে মৃত্যুর এই মিছিল বন্ধ করতে হলে শক্তিশালী সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।’ গতকাল ‘ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেমবারেন্স ফর রোড ট্রাফিক ভিক্টিমস’ উপলক্ষে নিটোরে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোড সেফটি কোয়ালিশন অব বাংলাদেশের উদ্যোগে বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এ আয়োজন করে। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্মরণে প্রতিবছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বব্যাপী এ দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো- ‘সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত মানুষদের স্মরণ করো, তাদের পাশে দাঁড়াও এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করো।’ নিটোর মিলনায়তনে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বিশিষ্ট সাংবাদিক মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজী। তিনি বলেন, ‘সড়ক আইন যথাযথভাবে কার্যকর করা গেলে সড়ককে নিরাপদ করা সম্ভব। কিন্তু আইনটি এখনো কার্যকর করা যাচ্ছে না। কালো ফিতায় আইনটি আটকে আছে। কারণ এটা কার্যকর হলে একটি মহলের ক্ষতি হবে।’ নিটোরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গণি মোল্লাহ?র সভাপতিত্বে সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব এবং নিটোরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক খন্দকার আবদুল আউয়াল রিজভী। তিনি বলেন, ‘সড়ককে নিরাপদ করতে হলে বিভিন্ন মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা দরকার। ঢাকার রাস্তায় শৃঙ্খলা আনাটা আগে জরুরি এবং এটার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল আমাদের রয়েছে।’ গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের ইন-কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর ড. শরিফুল আলম বলেন, ‘সড়ককে নিরাপদ করতে হলে জাতিসংঘ প্রণীত গাইডলাইন বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়ক নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ, নিরাপদ যানবাহন নিশ্চিত করা, ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ সড়কব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সড়কে দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং চালকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা।’ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার সাংবাদিক নিখিল ভদ্র বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের সারা জীবন এর বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাদের পরিস্থিতি আরও বেশি ভয়াবহ। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য রাষ্ট্রের, সমাজের কিছু দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন।’

সর্বশেষ খবর