বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কারাগার থেকেই বজলুর হুংকার

ফের সক্রিয় মাদক ব্যবসায়ীরা, চালু হয়েছে মাদক স্পট

নিজস্ব প্রতিবেদক

কারাগারে থেকেও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়ায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন ইউপি সদস্য বজলুর রহমান ওরফে বজলু। চনপাড়ায় সাম্প্রতিক অভিযানের পর থেকে বজলু গ্রেফতারের পর পর্যন্ত যারা মুখ খুলেছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের ডেকে নিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন বজলুর স্ত্রী সেলিনা ও তার মেজো মেয়ে রুমা। একই সঙ্গে তারা এলাকায় প্রচার করাচ্ছেন, ওপর মহলের সিগন্যাল ক্লিয়ার। শিগগিরই বজলু জামিনে বের হয়ে এলাকায় ফিরবেন। তখনই খেলা শুরু হবে। একাধিক সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। গতকাল বেলা ২টার দিকে এ প্রতিবেদককে ফোন করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন চনপাড়ার বাসিন্দা রোজিনা আক্তার নামের এক মহিলা। তিনি বলছিলেন, ‘বজলু গ্রেফতারের পর থেকেই আমরা আতঙ্কে আছি। তার স্ত্রী ও মেয়েরা আমাদের লোক পাঠিয়ে হুমকি দিচ্ছে। বলছে, যারা বজলুকে নিয়ে কথা বলেছে, তাদের সবাইকে কিছুদিনের মধ্যেই দেখে নেওয়া হবে। বজলুকে কোনোভাবেই বেশি দিন কারাগারে রাখা হবে না। ওপর মহলের লোকেরাই তাকে বের করে নিয়ে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী শমসের সব সময়ই বজলুর অপকর্মের প্রতিবাদ করে আসছিল। তবে মঙ্গলবার বিকালে পুলিশ পরিচয়ে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। থানায় গিয়েছিলাম। তবে কোনো খোঁজ পাইনি।’

ইয়াসমিন নামের একজন বলেন, ‘যারাই বজলুর কথার বাইরে গেছেন কিংবা তার অপকর্ম নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের হয় অস্ত্র নতুবা মাদক দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে। আমার স্বামী গুলশানে থাকে। তাকেও একটি খুনের মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে বজলু। ভাই, তার কথাই চনপাড়ায় আইন। মিডিয়ায় নিউজ হওয়ায় আমরা বিশ্বাস করছিলাম এবার তার বিচার হইব। সে গ্রেফতার হওয়ায় সাধারণ মানুষ খুব খুশি হইছিল। এলাকায় মিলাদ ও দোয়া হইছে। কিন্তু এখন কী শুনতেছি ভাই! এখন সাধারণ মানুষকে কে বাঁচাইব!’ পরে চনপাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক নিরীহ মানুষ পুনরায় আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। বজলু এবং মাদক নিয়ে কথা বলেছিলেন এমন অনেকের বাড়িতেই লোক পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। হুমকি পাওয়া অনেকেই এলাকা ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগেও অস্ত্র ও মাদক দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছিল এমন একজন বলেন, ‘আমাদের পাঁচ-ছয়জনের নাম বলছে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত ১০ জন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই, কথা বলে কি আমরা অন্যায় করেছি? আপনারাই তো বজলুর খবরের সত্যতা পেয়ে খবর প্রচার করেছেন। আমরা ভেবেছিলাম এবার হয়তো ভালো কিছু হবে। কিন্তু কী হতে যাচ্ছে!’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলছিলেন, ‘শমসের স্বেচ্ছাসেবক লীগের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। বজলু ও তার পরিবারের সদস্যদের অপকর্মের প্রতিবাদ করত শমসের। এ জন্য তাকে অনেকবার নানা মামলায় ফাঁসিয়েছে বজলু।’ কেউ কেউ বলছিলেন, ‘বজলুর পরিবারের সদস্যরা চনপাড়ায় নতুন করে লিস্ট করছে। এই লিস্টে রয়েছে অন্তত ১৫ জনের নাম। মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা উঠাইছে বজলুর বিরুদ্ধে মুখ খোলা ব্যক্তিদের দেখে নেওয়ার জন্য।’ জানা গেছে, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে বজলুর সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। চনপাড়া নামের এ অন্ধকার জগতের একচ্ছত্র অধিপতি তিনি। তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করতেও সাহস পান না চনপাড়ার কেউ। নিজের প্রয়োজনে যাকে-তাকে তুলে নিয়ে আসা হয় বজলুর ডেরায়। সেই ডেরায় বাইরে থেকেও অনেক ভুক্তভোগীকে অপহরণ করে আনা হয়। টর্চার সেলে রেখে করা হয় অমানুষিক নির্যাতন। মাদক, চাঁদাবাজি, ডিসকো পার্টি, দেহব্যবসা, রাহাজানি, দখলসহ সব কটি সেক্টর থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের মাসোহারা চলে যায় তার পকেটে। ফের সক্রিয় মাদক ব্যবসায়ীরা : চনপাড়ায় ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাদক ব্যবসায়ীরা। কিছুদিন কিছুটা লুকিয়ে মাদক ব্যবসা চালালেও এবার জমে উঠেছে মাদকের চিহ্নিত স্পটগুলো। এসব স্পটে এবার বজলুর হয়ে সমন্বয় করছেন ‘র’ আদ্যাক্ষরের এক মহিলা কাউন্সিলর এবং বজলুর দুই মেয়ে সুমি ও রিতা, ভাই মিজু, গুটি কাশেম, আনোয়ার ও বাদল। তারা ১, ৬, ৭ ও ৫ নম্বরের স্পটগুলোয় নিজেরা থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। তবে প্রতিটি স্পটের সামনেই রাখা হচ্ছে একটি বা দুটি করে ওয়াচ পার্টি। তারা পোশাকে বা সাদাপোশাকের পুলিশ-র‌্যাব দেখলেই সতর্ক করছে। সূত্র বলছে, চনপাড়া বস্তিতে মাদকের স্পট রয়েছে প্রায় ২০০। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি গ্রুপ থেকে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা করে চলে যেত বজলুর পকেটে। সে অনুসারে প্রতিদিন কেবল মাদক স্পট থেকেই বজলুর কাছে যায় ন্যূনতম ৬ লাখ টাকা। কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বজলু নিয়ন্ত্রণ করেন এ ব্যবসা। গতকাল রূপগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদকে কয়েক দফা ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোন কেটে দেন।

প্রসঙ্গত, স্থানীয়রা বলছেন, ২০০৩ সালে রূপগঞ্জের সাবেক এমপি মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহর বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে ঝাড়ু-জুতা মিছিল করে আলোচনায় আসেন বজলু। ২০০৬ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় গ্রেফতার হন তিনি। ওই সময় তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা ছিল। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বিউটি ওরফে কুট্টির স্বামী এম এ হাসান এবং ২০১৯ সালের জুন মাসে কুট্টি খুন হলে বদলে যায় পরিস্থিতি। চনপাড়ার একক ‘নিয়ন্ত্রণ’ চলে আসে বজলুর কাছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যারাই চনপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তারাই হত্যার শিকার হয়েছেন। কুট্টি ও হাসান ছাড়াও আলোচিত হত্যাকান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে চান মিয়া, ফিরোজ সরকার, ফারুক মিয়া, পুলিশের এএসআই হানিফ মিয়া, ফালান মিয়া, আবদুর রহমান, খোরশেদ মিয়া, মনির হোসেন, আসলাম হোসেন, আনোয়ার, সজল ও সামসু হত্যাকান্ড।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর