শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

নৌপথ পুনরুদ্ধারে ধীরগতি

১০ বছরে সচল দ্বিগুণ নৌপথ, পণ্য পরিবহন বেড়েছে চার গুণ

শামীম আহমেদ

নৌপথ পুনরুদ্ধারে ধীরগতি

এক টন পণ্য প্রতি কিলোমিটার পরিবহনে যেখানে সড়কপথে ব্যয় হয় সাড়ে চার টাকা, রেলপথে আড়াই টাকা, সেখানে নৌপথে খরচ হয় মাত্র ৯৯ পয়সা। পরিবহন খরচ বেঁচে যাওয়ায় কমে আসে পণ্যের দাম। সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ঝুঁকছে নৌপথ উন্নয়নে।

এতেই ১০ বছরের ব্যবধানে নৌপথে পণ্য পরিবহন বেড়েছে চারগুণ। বর্তমান সরকার নির্বাচনী ইশতেহারেও ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর ঘোষণা দেয়। নেওয়া হয় নদী উদ্ধার ও খননে বড় বড় প্রকল্প। তবে সারা বছর ড্রেজিং চললেও সেই হারে বাড়েনি নৌপথ। গত ১০ বছরে নৌপথ বেড়েছে মাত্র ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে ৫ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল থাকছে।

এদিকে একদিকে চলছে ড্রেজিং, অন্যদিকে নতুন নতুন নৌরুটে পলি জমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যান চলাচল। বর্তমানে বর্ষা যেতেই সিরাজগঞ্জের  বেলকুচি, চৌহালী ও এনায়েতপুরে যমুনা নদীতে জেগে উঠেছে অসংখ্য ডুবোচর। ক্ষীণ হয়ে এসেছে নদী। প্রায়ই ডুবোচরে আটকে যাচ্ছে পণ্যবাহী জাহাজ-কার্গো। নাব্য হ্রাস পাওয়ায় বর্ষায় সাত কিলোমিটার প্রস্থের যমুনার এপাড়-ওপাড়ের দূরত্ব এখন দুই কিলোমিটার। নদীর বুকজুড়ে শোভা পাচ্ছে বোরো ধান, ভুট্টা, খেসারি, কালাই ও চিনাবাদামসহ বিভিন্ন ফসল। নতুন নতুন চর ওঠার কারণে চৌহালী থেকে এনায়েতপুর নৌকাঘাট হয়ে বেলকুচি উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতে শ্যালো নৌকায় এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে এখন লাগছে আড়াই ঘণ্টার বেশি। সারা বছর ড্রেজিং চললেও নাব্য সংকটের কারণে গত ২৭ জুন পদ্মায় মাঝিকান্দি-শিমুলিয়া নৌরুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নাব্য সংকটের কারণে প্রতি বছর বন্যাতেও ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। নাব্য সংকটে বর্তমানে বন্ধ আছে দাউদকান্দি-সোনামুড়া নৌরুট। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম, কালীগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর-বরিশাল, বরিশাল-পটুয়াখালী-গলাচিপা-পায়রা বন্দর, বরিশাল-পায়রা বন্দর (দুর্গাপাশা-চরকাজল হয়ে), বরিশাল-খুলনা (এমজি ক্যানেল হয়ে), মোংলা-আংটিহারা-রায়মঙ্গল, খুলনা-নোয়াপাড়া, ঢাকা-রামচর-মাদারীপুর, ঢাকা-নন্দিরবাজার-হুলারহাট, দপদপিয়া হয়ে বরিশাল-পটুয়াখালী, দুর্গাপাশা হয়ে বরিশাল-লালমোহন-ভোলা, বরিশাল-ঝালকাঠি-পাথরঘাটা, পটুয়াখালী-আমতলী, চাঁদপুরের হরিদা-আলুবাজার, নারায়ণগঞ্জ-মতলব, চাঁদপুর-মাওয়া-আরিচা নৌপথসহ দুই ডজনের বেশি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে যান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। এসব রুটের বিভিন্ন স্থানে গভীরতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের সময় বিআইডব্লিউটিএর পাইলট নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে চলাচলের অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কিছু নৌরুটে শুধু দিনের বেলায় চলাচল করতে বলা হয়েছে। এদিকে জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে এসব নৌরুটে অতিরিক্ত সময় লাগছে ১২ ঘণ্টার মতো। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৭ সাল থেকে ৪০ বছরে দেশের ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১০ সালের আগে নৌপথ ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটারে চলে এসেছিল। এখন শুষ্ক মৌসুমে ৫ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল থাকছে। এটা গত ১০ বছরের অর্জন। খননের পাশাপাশি মেইনটেনেন্স করায় সময় লাগছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল হবে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ, নদ-নদী সংরক্ষণ বিষয়ক টাক্সফোর্সের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশের ৪ শতাধিক নদ-নদীতে বছরে প্রায় ৩ কোটি টন পলি জমে। এসব পলি সরিয়ে নদীর প্রবাহ ফেরাতে প্রয়োজন ৮ লাখ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ২০০টি ড্রেজার। ১৯৬২-৬৭ পর্যন্ত নেডকোর সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে নদীপথের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। ১৯৮৭-৮৮ সালের সর্বশেষ জরিপে বর্ষাকালে বাংলাদেশে নদীপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে ৩ হাজার ৮২৪ কিলোমিটারে। এর পর অর্থাভাবে দীর্ঘদিন নৌপথের জরিপ হয়নি। সম্প্রতি নদ-নদীর পরিস্থিতি জরিপে কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য সচিব ও নদী গবেষক আমিনুর রসুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দূষণ-দখল ছাড়াও নিয়মিত নদী খনন ও রক্ষণাবেক্ষণ না করা, সড়কপথকে গুরুত্ব দেওয়া, নৌপথ উন্নয়নে পর্যাপ্ত বাজেট না রাখায় প্রতি বছর কমেছে নৌপথ। চলতি অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৭ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। অথচ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে ৩৬ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা আর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১৮ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএ, পাউবো, বিএডিসি, বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীন ড্রেজিংয়ের কারণেও পরিকল্পিত ড্রেজিং হচ্ছে না। ড্রেজিংয়ের বালু আবার নদীতেই ফেলা হচ্ছে। এভাবে চললে নদী সচল হবে কীভাবে? এ জন্য একটি আমব্রেলা প্রতিষ্ঠান দরকার ছিল। এদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে সড়কের পরিবর্তে নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করলে বাঁচবে ৫৮.৫ লিটার ডিজেল। পাশাপাশি ১ লাখ ৫৫ হাজার টন কম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হবে। এ ছাড়া পণ্য পরিবহন ব্যয় এক-পঞ্চমাংশে নেমে আসবে। এসব বিবেচনায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই সারা দেশের নদী উদ্ধারে পদক্ষেপ নেয়। ঢাকার চার নদী উদ্ধারসহ ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননে নেওয়া হয় বড় বড় প্রকল্প। এ ছাড়া গত জুলাইয়ে নৌ করিডরের সক্ষমতা বাড়াতে ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন প্রকল্প-১’ এর কাজ। এর আওতায় ৯০০ কিলোমিটার নৌপথে করা হচ্ছে পারফরম্যান্স বেজড কন্ট্রাক্ট ড্রেজিং। নির্মিত হবে ল্যান্ডিং স্টেশন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, যাত্রী ও কার্গো টার্মিনালসহ নানা অবকাঠামো। তবে সরকারের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে এলেও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক নৌপথও চালু হয়নি। কাজের ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়্যারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নৌপথগুলো উদ্ধারে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে অনেকগুলো নদী খনন করে নাব্য করতে পেরেছি। মূলত নাব্য সংকট হয় শুষ্ক মৌসুমে। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। বিআইডব্লিউটিএর বহরে এখন ৪৫টি ড্রেজার আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে আরও ৩০টির মতো ড্রেজার আছে।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে প্রতি বছর উজান থেকে দেশের নদীগুলোতে ১.২ বিলিয়ন টন পলি ভেসে আসে, যা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত ড্রেজিং না করায় নৌপথগুলো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

 অথচ, নৌপথে পরিবহন খরচ সড়কের চেয়ে অনেক কম। নৌপথে কন্টেইনার পরিবহন চালু ও পণ্য পরিবহন বাড়াতে পারলে তা বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর