মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

রোমহর্ষক ঘটনা আড়াল অপমৃত্যু মামলায়

মাহবুব মমতাজী

বিভিন্ন এলাকায় নির্যাতনের কারণে কোনো গৃহকর্মীর মৃত্যু হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একে ‘দুর্ঘটনায় মৃত্যু’ কিংবা ‘আত্মহত্যা’র কথা উল্লেখ করে অপমৃত্যুর মামলা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধামাচাপা পড়ে যায় আড়ালের ঘটনা। গত কয়েক বছরে কয়েকটি মামলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আড়ালের ঘটনা। তাহলে গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধারের পর এসব অপমৃত্যুর মামলা দিয়েই কি রোমহর্ষক ঘটনা চাপা দেওয়া হয়?

রাজধানীর গুলশান থানায় ২০১৮ সালের ১৫ মের অপমৃত্যু মামলা, ২০১৯ সালের ১২ জুন চকবাজার থানার অপমৃত্যুর মামলা এবং রামপুরা থানায় চলতি বছর ২৯ জানুয়ারি করা অপমৃত্যুর মামলার তথ্য বিশ্লেষণে আড়ালের কিছু ঘটনা বেরিয়ে এসেছে।

জানা যায়, ধর্ষণ আর নির্যাতনের পর ওই নারীদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু লাশ উদ্ধারের পরও হয়েছিল অপমৃত্যুর মামলা। সর্বশেষ পুরান ঢাকায় গৃহকর্মী সাজেদার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় লালবাগ থানায় ৬ অক্টোবর আত্মহত্যার প্ররোচনার একটি মামলা হয়। এ মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, এই নারীরও মৃত্যু হয়েছে নির্যাতন আর মারধরে।

গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সদস্যসচিব নাজমা ইয়াসমীন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা গত ১০ বছরের ১৪ জন গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার নিয়ে কাজ করেছিলাম। সেগুলো কিন্তু মেরে ফেলে কিংবা নির্যাতনের পর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়, কারণ গৃহকর্তারা প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। অনেক সময় পুলিশ এসবের মামলা নিলেও একটা পর্যায়ে ভুক্তভোগীর পরিবারের সঙ্গে আসামিদের মীমাংসা হয়ে যায়।

২০১৮ সালের ১৪ মে রাজধানীর গুলশানের ১২২ নম্বর রোডের ২৮ নম্বর বাসায় রিফা আক্তার (১৬) নামে এক গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার হয়। পুলিশ জানতে পারে, ওই গৃহকর্মী ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়। গুলশান থানার তৎকালীন এসআই সাইফুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন। তার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, রিফা আক্তার ১০-১১ বছর ধরে মাহবুবুল আলম খানের বাসায় কাজ করছিল। ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে রান্নাঘরের বেলকুনির গ্রিল বেয়ে সে নিচে নামছিল। পঞ্চম কিংবা চতুর্থ তলা থেকে দ্বিতীয় তলায় পড়ে গিয়ে সে গুরুতর আহত হয়। চিকিৎসার জন্য গুলশান থেকে তাকে মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিপরীতে অবস্থিত প্যান প্যাসিফিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পথে রিফা আক্তারের মৃত্যু হয়। তখন হাসপাতালে না নিয়ে তাকে রাস্তা থেকে অ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে গুলশানের বাসায় নিয়ে আসা হয়। পরে গৃহকর্তা পুলিশে খবর দিলে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক মর্গে পাঠায়। ১৫ মে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা নেওয়া হয়।

গুলশান থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক সে সময় জানিয়েছিলেন, ওই গৃহকর্মী বাড়ির পেছন দিক থেকে নেমে পালিয়ে যাচ্ছিল। পরে চতুর্থ তলা থেকে নিচে পড়ে যায়। এরপর তার মৃত্যু হয়।

গুলশান থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন ২০১৯ সালের ২৬ জুন আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রিফা আক্তারের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেন ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক ও মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস। ময়নাতদন্তে রিফার ওপর থেকে পড়ে যাওয়া এবং তার শরীরে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। এই রিপোর্ট পাওয়ার পরই ২০১৯ সালের ১৪ জুন গুলশান থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আরেকটি মামলা হয়। এদিকে চলতি বছর ২৯ জানুয়ারি রামপুরার হাজীপাড়ার ২৭৯/৫ নম্বর বাসা থেকে ইতি আক্তার (১২) নামে এক গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার করা হয়। গৃহকর্তা রাজিন আহম্মেদ ও গৃহকর্ত্রী রিফাত জাহান ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে স্থানীয় বেটার লাইফ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে খবর পেয়ে রামপুরা থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় রামপুরা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। মামলা নম্বর-১। গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী তখন পুলিশকে জানায়, ইতির গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য বিষণ্নতায় ছিল। গ্রামের বাড়িতে যেতে না পারায় ওই বাসায় জানালার গ্রিলের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ফাঁস নেয়।

রামপুরা থানায় গিয়ে জানা যায়, ওই মামলা তদন্ত করছিলেন এসআই তওফিকা ইয়াসমিন। তিনি লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করে জানতে পারেন, ইতি ফাঁসিতে ঝুলে থাকার কারণে শ্বাস বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। তবে মৃত্যুর আগে তাকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। এরপর ২২ নভেম্বর একই থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন ইতির মা ছারকিস আক্তার। মামলা নম্বর-১৯।

এ বিষয়ে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মামলাটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছি। ধর্ষণে জড়িতরা দ্রুতই শনাক্ত হবে। আর লাশ উদ্ধারের সময় আমাদের কাছে ধর্ষণ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য-প্রমাণ ছিল না।’ মামলার বাদী ছারকিস আক্তার জানিয়েছেন, ইতি যে বাসায় কাজ করত ওই বাসায় থাকতেন গৃহকর্তা রাজিন আহম্মেদ, তার বাবা কামাল উদ্দিন আহমেদ, মা কহিনুর কামাল, স্ত্রী রিফাত জাহান চৌধুরী এবং আরেক কাজের মেয়ে রোকেয়া।

২০১৯ সালের ১২ জুন ঢাকা পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের স্টাফ কোয়ার্টার পুকুর থেকে আজমেরি (২৬) নামে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই দিনই চকবাজার থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। মামলা নম্বর-১০। পরে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ধর্ষণের পর হত্যার আলামত পাওয়া গেলে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি একই থানায় আরেকটি মামলা হয়। মামলা নম্বর-২৭।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ মামলা প্রথমে তদন্ত করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক গাজী মো. ইব্রাহীম। পরে তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়েছে। এখনো কোনো সংস্থা ওই নারীকে ধর্ষণের পর হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি। তবে লাশ উদ্ধারের সময় সুরতহালে ধর্ষণ ও হত্যার প্রাথমিক আলামত অনুধাবনের পরও অপমৃত্যু মামলা হওয়ায় অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) নাজমুল হাসান ফিরোজকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর ওই লাশের সুরতহালকারী এসআই জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাকে শিল্পপুলিশে বদলি করা হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) সূত্র জানায়, ২০১১ সালে গৃহশ্রমিক হত্যা হয়েছে ৩৮ জন, ২০১২ সালে ৪৬ জন, ২০১৩ সালে ৩২ জন, ২০১৪ সালে ২৭ জন, ২০১৫ সালে ৩৯ জন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ৩৮ জনকে হত্যা করা হয় এবং তিনজন আত্মহত্যা করেন। ২০১৭ সালে ২৭ জনকে ও ২০১৮ সালে ১৮ জনকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালে চারজন আত্মহত্যা করেন। ২০১৯ সালে ১৭ জনকে হত্যা করা হয়, আত্মহত্যা করেন একজন এবং নিখোঁজ হন একজন। ২০২০ সালে ১৬ জনকে হত্যা করা হয়, আত্মহত্যা করেন চারজন এবং নিখোঁজ থাকেন একজন। ২০২১ সালে ১২ জনকে হত্যা করা হয় এবং আত্মহত্যা করেন দুজন। আর চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত নয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর