পারিবারিক কলহ, আর্থিক অসচ্ছলতা, পরকীয়া, সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলাসহ বেশকিছু কারণে ভুক্তভোগী স্বামী-স্ত্রীর কেউ কেউ হতাশা থেকে আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হচ্ছে না। তারা নিজেদের সম্পর্কের অবনতির কারণে বা কোনো কিছুতে ব্যর্থ হয়ে কেড়ে নিচ্ছেন তাদের অবুঝ সন্তানের প্রাণ। মানে বড়দের বিবাদে প্রাণ যাচ্ছে কোমলমতি শিশুদের। ভয়াবহ এ সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
তাঁরা বলেন, ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’ এ বার্তা সমাজে ছড়িয়ে দিতে মোটিভেশন দরকার। নিজের শিশুর হত্যাসহ একজন ব্যক্তির আত্মহত্যা করার মতো অপরাধ রোধে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি পথঘাট ও গ্রামগঞ্জে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। রাজধানীর হাজারীবাগের রায়েরবাজারে ৮ ডিসেম্বর একটি বাসায় হাসিনা বেগম (৩০) নামে এক মা তার তিন বছর ও ছয় মাস বয়সী দুই শিশু সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন। পুলিশের ধারণা, হাসিনা বেগম তার দুই শিশু সন্তানকে গলা টিপে হত্যার পর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। তদন্তসংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, পারিবারিক কলহের জেরে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ২৯ অক্টোবর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে এক নারী তার ছেলে-মেয়েসহ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ঘটনা ঘটার সময় উপস্থিত লোকজন তাদের বাধা দেন। পরে পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। সেই নারী জানান, নিজের জমি ও বাড়ি রক্ষার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এর আগেও তিনি কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
চলতি বছরের ৩১ মে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে কীটনাশকপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন গৃহবধূ সোনিয়া আক্তার (২৬)। জানা যায়, পারিবারিক কলহের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় পারিবারিক কলহের জেরে পাঁচ বছরের শিশু সন্তানসহ ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আরেক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। সেদিন ঢাকাগামী কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনার পেছনেও কারণ হিসেবে পারিবারিক কলহকে চিহ্নিত করা হয়। ১৯ মার্চ পারিবারিক কলহের কারণে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এক পিতা। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার জালকুড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে পুলিশকে বিষয়টি জানালে পুলিশি তৎপরতায় তাদের প্রাণ বেঁচে যায়। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বব্যাপী মানসিকভাবে মানুষ খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছে। এ ছাড়া আমাদের নৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল। আগে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো সেভাবে প্রচার হতো না। ফলে এ ঘটনা সম্পর্কে জানার সুযোগ ছিল না। এখন পরকীয়া, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি কারণে কেউ তার সন্তানসহ আত্মহত্যা করলে সে খবর গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। আর এ খবর পড়ে অন্যরা নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পেয়ে তারাও এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে চায়। এতে সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অবুঝ শিশুদের ওপর। কোনো কিছু না বুঝেই তাদের এ পৃথিবী থেকে চলে যেতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে ইউএনও, মেয়রসহ ইউনিয়ন পরিষদে যাঁরা আছেন তাঁদেরও এটা নিরোধে করণীয় আছে। যেখানে জনসমাগম হয় সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দিয়ে এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ বিষয়ে ঘরে ঘরেও সচেতনতা প্রচার প্রয়োজন।’