সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

অর্থনীতিতে সংকটের চেয়ে চ্যালেঞ্জ বেশি

মানিক মুনতাসির

অর্থনীতিতে সংকটের চেয়ে চ্যালেঞ্জ বেশি

ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা কাটছে না। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। অন্যান্য পণ্যের বাজারেও রয়েছে অস্থিরতা। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স না বাড়ায় আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলানো যাচ্ছে না। যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে অব্যাহতভাবে। সরকারের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সেও বিরাজ করছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও ভর্তুকি থেকে বেরোতে পারছে না সরকার। কৃষি খাতের ভর্তুকি কমিয়ে আনায় কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে। তবে এসব সংকটকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছে অর্থ বিভাগ। এসব চ্যালেঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিই বা কী হবে। সরকারের বাজেট বাস্তবায়নও থমকে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া আগামী বছরের অর্থনীতি কেমন হবে। কেননা ২০২৩ সালের পর ২০২৪ সালের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কী ধরনের নীতি গ্রহণ করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য আর্থিক, মুদ্রা ও মুুদ্রার বিনিময় হার-সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক ডেকেছেন অর্থমন্ত্রী। ২০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে সামষ্টিক অর্থনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি ৩৫ মিলিয়ন ডলার আগামী ফেব্রুয়ারিতেই পাওয়ার কথা রয়েছে।

এদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭-এর নিচে নামিয়ে আনা হতে পারে। অবশ্য বাজেট ঘোষণার সময়ও পরিস্থিতি খুব একটা ইতিবাচক ছিল না। তবু তখন উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া বাজেটে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে ধরে রাখার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। যদিও সে সময়ও মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ শতাংশের ওপরে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির এই চাপ প্রায় ৯ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যমতে, গত নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির এই চাপ দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অক্টোবরে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, এটা দেশের মূল্যস্ফীতির প্রকৃতি চিত্র নয়। দ্রব্যমূল্যের বাস্তব অবস্থা আমলে নিলে এই চাপ আরও অনেক বেশি হবে বলে তারা মনে করেন। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার কৌশল কী হতে পারে সে বিষয়েও আলোকপাত করা হবে কালকের সভায়। আর্থিক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই বৈঠকে, যা প্রতি অর্থবছরে দুবার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

অর্থ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, কালকের সভায় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি), রপ্তানি, আমদানি, রাজস্ব আদায়, মূল্যস্ফীতি, বাজেট বাস্তবায়ন, রিজার্ভ, ডলারের দর,  রেমিট্যান্সসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। অন্যদিকে বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতি ও জিডিপি নিয়ে আলোচনা করা হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘অর্থনীতি নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে। আমরা কোনো সংকটকেই সংকট হিসেবে দেখছি না। এগুলো আমাদের জন্য একেকটি চ্যালেঞ্জ। চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অনেক দেশই সংকটে রয়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমরা এড়াতে পারি না। এগুলো মোকাবিলা করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। সামনের বছর এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ভালো ফলও পাওয়া যাবে। এ ছাড়া আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি ফেব্রুয়ারিতে পাওয়ার কথা। পাশাপাশি অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঋণের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সামনের বছর প্রথম দিকে যেগুলোর উল্লেখযোগ্য অর্থ পাওয়া যাবে, যা দেশের অর্থনীতিতে এক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।’

এদিকে দুই মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা হ্রাস পেলেও এখনো তা সরকারি হিসাবে ৮ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গেল নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এটি অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের মূল্যস্ফীতি সরকারি হিসাবের চেয়ে আরও বেশি এবং তা ১২ শতাংশের ওপরে রয়েছে। শুধু মূল্যস্ফীতি নয়, অক্টোবরে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতিও বেড়েছে। রেমিট্যান্স ও আমদানি থেকে পাওয়া অর্থের তুলনায় আমদানিতে ব্যয় বেশি হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরের শেষে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে ঘাটতির পরিবর্তে ৪ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। এই ঘাটতি বাড়তে থাকার অর্থ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে। দেশের রিজার্ভের পরিমাণও ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে সাড়ে তিন মাস আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। যদিও সরকার এখনো বলছে, রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার করা জরুরি। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকই নয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, নেজা, বিডা, জয়েন স্টক কোম্পানি, ইপিবি এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু জায়গায় সংস্কার করা খুবই জরুরি। বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমাদের যতটা না সংকটে ফেলেছে, এর চেয়ে বেশি সংকট তৈরি হয়েছে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি না থাকার কারণে।’ এ খাতে স্বচ্ছতা, সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে সামনের দিনে সংকট আরও বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর