বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

অর্জন চ্যালেঞ্জ দুই-ই ছিল বিদ্যুৎ জ্বালানিতে

জিন্নাতুন নূর

অর্জন চ্যালেঞ্জ দুই-ই ছিল বিদ্যুৎ জ্বালানিতে

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২০২২ সালে অর্জনের পাশাপাশি ছিল চ্যালেঞ্জও। এ বছর একদিকে শুরু হয় শতভাগ বিদ্যুতায়ন, আমিনবাজার-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়, এতে রামপাল-পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে পৌঁছানো শুরু হয়; অন্যদিকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে জ্বালানির বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। আর সেই ধাক্কা এসে লাগে বাংলাদেশেও। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতে গ্রাহকের ওপর চাপে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা। এর পাশাপাশি বিশ্ববাজার থেকে মাত্রাতিরিক্ত দাম দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনে সামাল দিতে না পারায় এই জ্বালানির আমদানি বন্ধ করে বাংলাদেশ। এর ফলে জ্বালানি সংকট থেকে দীর্ঘদিন পর আবারও দেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরু হয়। কারিগরি ত্রুটির কারণে এক মাসের ব্যবধানে দুবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এই চাপ সামলাতে সরকার জ্বালানি তেলের নতুন বাজার অনুসন্ধান শুরু করেছে। শুরু হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম। সব মিলিয়ে অর্জনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ-জ¦ালানির জন্য চ্যালেঞ্জপূর্ণ একটি বছর ছিল ২০২২। চলতি বছরের শুরুতেই উৎপাদনে আসে দেশের সবচেয়ে বড় পায়রা তাপভিত্তিক কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ বছরের মার্চেই দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় সেবা পৌঁছে দিয়ে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু ২০২২-এর জুনেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে থমকে যায় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের অগ্রগতি। যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। জ্বালানি তেলের আমদানি কমানোর পাশাপাশি মূল্য বৃদ্ধিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুদ্ধের কারণে বিশ্বে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এতে বিপুল লোকসান গুনতে হয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি)। লোকসান কমাতে ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে বেড়ে হয় ১১৪ টাকা আর পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা। অকটেন ৮৯ টাকা থেকে হয় ১৩৫ টাকা। তবে দাম বাড়ানোর ২৩ দিনের মাথায় এসব জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়। জুলাই ২০২২ থেকে স্পট মার্কেট থেকে (এলএনজি) আমদানি বন্ধ করে সরকার। এতে গ্যাসভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। জ্বালানি সাশ্রয়ে ব্যয়বহুল কিছু তেলভিত্তিক বিদু্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রাখে সরকার। ফলে জ্বালানি সংকটের কারণে জুলাই মাসে শুরু হয় এলাকাভিত্তিক রুটিন লোডশেডিং। এতে রাজধানীতে গড়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা, বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অফিস-আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে গ্রাহকরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। শিল্প খাতেও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হয়।  জ্বালানি সাশ্রয়ে ১৯ জুলাই থেকে সারা দেশে দিনে একবার এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের ঘোষণা আসে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে। কিন্তু নির্ধারিত সময়সূচির চেয়ে বেশি লোডশেডিংয়ে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। পরবর্তী সময়ে সপ্তাহে এক দিন এলাকাভিত্তিক শিল্প-কারখানাতেও লোডশেডিং দেওয়া হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মঘণ্টা এক ঘণ্টা কমানো হয়। শীতে লোডশেডিং কমে আসে।

২০২২ সালেই দুবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। প্রথমে সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় কুষ্টিয়া, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো প্রায় দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল। এরপর অক্টোবরের ৪ তারিখে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় বিদ্যুৎহীন ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। বেশ কিছু এলাকা রাত ১২টার পরও বিদ্যুৎহীন ছিল। এ ঘটনায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ না থাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা, টেলিযোগাযোগ ও ব্যাংকিং সেবা ব্যাহত হয়। এই ব্ল্যাক আউটের কারণে দেশের সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করেন। বছরের শেষে এসে দেশীয় উৎস থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো এবং নতুন উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রম গ্রহণ করে সরকার। একই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে তেল-গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়।  এর আগে ৫ জুন পাইপলাইনে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের পাইকারি দাম ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বৃদ্ধি করে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), যা জুন মাস থেকে কার্যকর হয়। এতে রান্নার গ্যাসের জন্য দুই চুলার মাসিক বিল ৯৭৫ থেকে বৃদ্ধি করে ১০৮০ টাকা করা হয়। আর এক চুলায় মাসিক বিল ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৯৯০ টাকা। আর প্রিপেইড মিটারে প্রতি ইউনিটের খরচ ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৮ টাকা। ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি পর্যায়ে দাম বেড়েছে ১৯.৯২ শতাংশ। ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে হয় ৬ টাকা ২০ পয়সা। বছরের শেষে এসে পদ্মার ওপর দিয়ে আমিনবাজার-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন চালু হয়। আর এটি চালু হওয়ায় ১৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ১৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। পটুয়াখালীতে দেশের বৃহৎ পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২১ মার্চ। যদিও বছরের শেষে আমিনবাজার-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। এ জন্য বাগেরহাটে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ বিনিয়োগে ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একটি ইউনিটের বিদ্যুৎ পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর