বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মশার ওষুধে কাজ হচ্ছে না কেন

♦ ২২ বছরে ৭০০ কোটি টাকা খরচ করপোরেশনের ♦ ২৫ মার্চ পর্যন্ত মশা বৃদ্ধির আশঙ্কা কীটতত্ত্ববিদদের ♦ ওষুধ পরিমাণমতো না দেওয়ার কারণে কমছে না : বিশেষজ্ঞ

হাসান ইমন

মশার ওষুধে কাজ হচ্ছে না কেন

রাজধানীর অভিজাত থেকে বস্তি, ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও মশা থেকে মুক্তি মিলছে না। ছোট এই কীটপতঙ্গের কাছ থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউই। ওষুধ-কয়েল জ্বালিয়েও রেহাই পাচ্ছে না মেগাসিটি ঢাকার কোটি মানুষ। এ যেন এক অদৃশ্য লড়াই। গত ২২ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশার পেছনে ৭০০ কোটি টাকা খরচ করলেও কোনো সফলতার মুখ দেখেনি। উল্টো বেড়েছে মশার উপদ্রব। তবে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, গবেষণায় দেখা গেছে মার্চের ২৫ তারিখ পর্যন্ত কিউলেক্স মশার উপদ্রব বাড়বে। এ ক্ষেত্রে করপোরেশনগুলো সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজ করলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে মশার উপদ্রব অনুযায়ী পরিমাণমতো ওষুধ স্প্রে করলে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে বলে মনে করছেন রসায়নবিদরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে শহরের গোড়াপত্তনের শুরু থেকে ঢাকায় মশার উপদ্রব ছিল। সে সময়ও মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারগুলো কাজ করেছে। সেই কার্যক্রম এখন আরও জোরদার করা হয়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন মশার উপদ্রব বেড়েছে। এ খাতে বিপুল অর্থ খরচও করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো সুফল মিলছে না। আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে বাংলাদেশে মশা ও মশাজাতীয় কীটপতঙ্গের উপদ্রব বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে জলাবয়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এসব কীটপতঙ্গের উপদ্রব অনেকাংশে বেড়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের গবেষণা, মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান, প্রস্তুতি ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, এর বড়ই অনুপস্থিতি রয়েছে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই সময়টা হচ্ছে কিউলেক্স মশার প্রজননের সময়। আর এই কিউলেক্স মশা জন্মায় পুকুর, ডোবা, নর্দমায়। দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেক ডোবা ও নর্দমার উপস্থিতি আছে। সে জন্য মশার উপস্থিতি বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, মার্চ মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত কিউলেক্স মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পাবে।

মশা নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, পুকুর, ডোবা ও নর্দমাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। একই সঙ্গে কাজ করতে হবে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবীব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সিটি করপোরেশনের যারা মশক নিধন কর্মী রয়েছেন, তারা হয়তো সঠিক পরিমাণ ওষুধ স্প্রে করেন না। হয় তারা জেনে কম দিচ্ছেন, নাহয় জানেন না কোন স্থানে কী পরিমাণ ওষুধ দিতে হবে। এলাকাভিত্তিক মশার জরিপ করে পরিমাণমতো ওষুধ প্রয়োগ করলে সেটি কার্যকর হবে বলে মনে করেন তিনি। জানা যায়, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরের মশক নিয়ন্ত্রণ খাতে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এতে কোনো সুফল পাননি নগরবাসী। বিপুল পরিমাণ এই অর্থের অপচয় হয়েছে। মশক নিধনের নামে এসব অর্থ লুটপাটও করেছে দুই সিটির দুর্নীতিবাজ চক্র। এ জন্য নগরবাসী ও কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা ঢাকার মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নিয়ে বরাবর অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেসব কথা আমলে নেয়নি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা সফরে গিয়ে নিজেদের মশক নিয়ন্ত্রণে ভুল কাজের কথা স্বীকার করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে। সে কারণে ডিএসসিসি এলাকার মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জানতে চাইলে ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসিতে ১১০ জন মশক নিধন কর্মী কাজ করছেন, যারা সকাল-বিকাল নিয়মিত ওষুধ স্প্রে করছেন। এ জন্য ডিএসসিসি এলাকার মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মার্চ মাস পর্যন্ত মশার উপদ্রব বাড়বে বিশেষজ্ঞদের এমন মত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই মতের সঙ্গে একমত হতে পারছি না। ডিএসসিসি এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মশার প্রজনন কমাতে খাল, নর্দমা ও আদি বুড়িগঙ্গার পরিষ্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আশা করি ডিএসসিসি নিজ এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্ভব হবে।’ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও কাভার্ড ড্রেন রয়েছে, যেগুলোতে মশার ওষুধ ছিটানো সম্ভব হয় না। পাশাপাশি প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী, পলিথিন, ডাবের খোসাসহ বিভিন্ন আবর্জনায় ওই ড্রেনগুলো ভরাট থাকে। দুই ভবনের মাঝখানের জায়গাগুলো আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, যে কারণে ড্রেন দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয় না। জমাটবদ্ধ এসব পানিতে কিউলেক্স ভয়াবহরূপে বংশবিস্তার করছে। এসব স্থানে মশার প্রজনন ধ্বংস করতে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না। আর জলাশয়, খাল, নর্দমা ও যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী ও ডাবের খোসার পানিতে ভয়াবহরূপে মশার বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে। এসব কারণে মশক নিধনে দুই সিটি পর্যাপ্ত অর্থ খরচ করলেও নগরবাসীকে মশার ধকল সইতে হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর