শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মাঠে প্রচারণা শুরু দুই দলেরই

শেখ রুহুল আমিন, ঝিনাইদহ

মাঠে প্রচারণা শুরু দুই দলেরই

ঝিনাইদহ এক সময় বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু দলীয় কোন্দল ও সাংগঠনিক দুর্বলতায় বিগত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনে বিএনপির এক একটি করে আসন হাতছাড়া হতে থাকে। গত সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহের চারটি আসনের মধ্যে চারটিতেই জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনেও সবকটি আসনই দখলে রাখতে চায় দলটি। তবে বিএনপি প্রার্থীদের সঙ্গে তীব্র লড়াই করেই জিততে হবে আওয়ামী লীগের। এরই মধ্যে উভয় দলের প্রার্থীরা মাঠে তৎপরতা এবং প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেছেন। বিগত দিনের ভুলত্রুটি তুলে ধরে প্রার্থীরা একে অপরের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখছেন।

জেলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলেই কোন্দল-বিভক্তি রয়েছে। এ ছাড়া মাঠে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে প্রার্থিতার ঘোষণা না দিলেও মাঝে-মধ্যে তারা ঝটিকা মিছিল করে নিজেদের অবস্থান জানান দেন।

ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) : এখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই। তিনি পর পর চারবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন এ আসন থেকে। বর্তমানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জানান দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের মেয়ে পারভীন জামান কল্পনা। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি শৈলকুপার দলীয় নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং কাছেও টানছেন। এ ছাড়া আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ লীগের সহসভাপতি বিশিষ্ট শিল্পপতি নজরুল ইসলাম দুলাল নেতা-কর্মীদের কাছে যাচ্ছেন এবং মনোনয়নের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। পাশাপাশি শৈলকুপার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা নায়েব আলী জোয়ার্দার, ঝিনাইদহ কলেজের অধ্যক্ষ বাদশা আলমসহ অনেকেই নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায়।

বিএনপি থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ গত সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান। এবারও দল নির্বাচনে অংশ নিলে তিনি নির্বাচনে লড়বেন। তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর রাখছেন এবং বিপদ-আপদে পাশে থাকছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির খুলনা বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু গত সংসদ নির্বাচনে এ আসনে যৌথভাবে দলীয় মনোনয়ন পান। শেষ পর্যন্ত তিনি দলীয় নির্দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়নের জন্য জোর চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন। কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সহসভাপতি ওসমান আলী বিশ্বাস ও সাবেক এমপি আবদুল ওহাব আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন।

এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির শৈলকুপা উপজেলা সভাপতি মনিকা আলম ও সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান ফুল মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। তবে ইসলামী আন্দোলন একক প্রার্থী হিসেবে রায়হান উদ্দিনের নাম ঘোষণা করেছে। তাদের সাংগঠনিক অবস্থা অনেকটা ভালো।

ঝিনাইদহ-২ আসন (হরিণাকুণ্ডু ও সদরের একাংশ) : ঝিনাইদহ-২ আসন জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আসন। এ আসনের মনোনয়নের জন্য বর্তমান এমপি তাহজীব আলম সিদ্দিকী নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর ও সভা-সমাবেশ করছেন। শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু থেমে নেই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সদর পৌর মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু। তিনি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করেছেন। তবে দুর্নীতির মামলা তাকে অনেকটা বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে। তার অনুসারীদের দাবি, তাকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষ ফাঁসিয়েছে। এ ছাড়া ক্লিন ইমেজ খ্যাত জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম অপু। তিনি তার মতো করে ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে থাকেন। তার রয়েছে নেতা-কর্মীদের একটি বলয়। তিনি এবারও দলীয় মনোনয়ন লাভের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ মজিদ সংগঠনকে শক্তিশালী করার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মসিউর রহমানের মৃৃত্যুতে এম এ মজিদ আরও শক্তিশালী হয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে তার বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন প্রয়াত মসিউর রহমানের ছেলে কেন্দ্রীয় ড্যাপ নেতা ইব্রাহিম খলিল বাবু। তিনি গত সংসদ নির্বাচনে এম এ মজিদের পাশাপাশি দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। তিনি বর্তমানে দলীয় একাংশকে সঙ্গে নিয়ে নিজস্ব বলয় গড়ে তুলেছেন এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। এবারও নির্বাচন করার জন্য তিনি শহর ও গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার সাঁটিয়েছেন। এ ছাড়া জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা জিয়া পরিষদের সভাপতি কামাল উদ্দিন মনোনয়ন যুদ্ধে নামবেন বলে জানিয়েছেন।

জাতীয় পার্টির জি এম কাদের-পন্থি জেলা সভাপতি রাশেদ মাজমাদার, রওশন এরশাদ-পন্থি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা আহ্বায়ক মিজানুর রহমান প্রার্থী হতে তাদের ইচ্ছা পোষণ করে দলীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একক প্রার্থী হিসেবে ডা. এইচ এম মমতাজুল করিম নাম ঘোষণা করেছেন। স্বাধীনতা পার্টির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজু এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

ঝিনাইদহ-৩ (মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর) : ঝিনাইদহ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী দলীয় মনোনয়নের জন্য চেষ্টা করছেন। এদের মধ্যে বর্তমান এমপি শফিকুল আজম খান চঞ্চল অন্যতম। তিনি এ আসনে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এরই মধ্যে তিনি মহেশপুর ও কোটচাঁদপুরে শক্তিশালী কর্মী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক এমপি নবী নেওয়াজ। তিনিও মহেশপুরের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছেন। সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে বর্তমান এমপি ও সাবেক এমপির মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক। অন্যদিকে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে নিজের অবস্থান ধরে রাখছেন মহেশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাজ্জাদুল ইসলাম সাজ্জাদ। তিনি প্রতিনিয়ত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ডাকে মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছেন। দলীয় মনোনয়নের জন্য তিনিও জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মহেশপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মজুদ্দিন হামিদ নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন।

এ আসনে বিএনপি-জামায়াতের বরাবরই সাংগঠনিক অবস্থা ভালো। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে আগের মতো অবস্থান নেই তাদের। তবে সাবেক এমপি শহীদুল ইসলাম মাস্টারে ছেলে ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি মেহেদি হাসান রনি, কেন্দ্রীয় বিএনপির তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সহসম্পাদক আমিরুজ্জামান খান শিমুল মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।

জামায়াতের কোনো প্রার্থীকে এখানো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা যায়নি। মহেশপুর উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবদুর রহমান নির্বাচনের জন্য গণসংযোগ করছেন। আগে থেকেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একক প্রার্থী হিসেবে মাওলানা সারওয়ার হোসেন প্রচার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ ও সদরের একাংশ) আসন : এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে একক প্রভাব বিস্তার করেছেন কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বর্তমান এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার। উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলেও এখানো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। দুই সদস্য কমিটির সভাপতি সাবেক এমপি আবদুল মান্নান মারা গেছেন। এখানে সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আজিম আনার আওয়ামী লীগের সবকিছু। বর্তমানে নেতা-কর্মীদের তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রকাশ্যে এ আসন থেকে তিনবারের ইউপি চেয়ারম্যান ও সাবেক যুবলীগের সভাপতি আয়ুব হোসেন খান, লায়ন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আনোয়ার পারভেজ সাগর ও সাবেক পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান বিজু মনোনয়নের জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। এ ছাড়া কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ও কালীগঞ্জ সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান মতি নির্বাচন করার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপি থেকে সাবেক সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান বেল্টু ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি কামাল আজাদ পান্নু, সাবেক প্যানেল মেয়র হামিদুল ইসলাম হামিদ নির্বাচন করবেন বলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাবেক এমপি নুর উদ্দিন ও জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক বাচ্চু মণ্ডল মনোনয়ন চাইবেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি আহমেদ আবদুল জলিল নির্বাচনী মাঠে কাজ করছেন।

সর্বশেষ খবর