মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
মানবাধিকার ও শ্রম পরিবেশ

দুই ক্ষেত্র উন্নয়নে তাগিদ, মুক্ত বাণিজ্যেও শর্ত জাপানের

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

দুই ক্ষেত্র উন্নয়নে তাগিদ, মুক্ত বাণিজ্যেও শর্ত জাপানের

জাপানের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে চাইলে বাংলাদেশকে মানবাধিকার ও শ্রম পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে জাপান। রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের মানবাধিকার ও শ্রম খাতের কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নে সুনির্দ্দিষ্ট শর্ত ও সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এরই মধ্যে সে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর পর এবার এ দুটি ইস্যুতে কথা বলছে জাপান। এশিয়ার এ দেশটিকেও শ্রম খাতে কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারের বিষয়টি জানানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানান, ঢাকা সফররত জাপানের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মি. নাকাতানি জেন গতকাল সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নিয়ে জাপান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন মি. নাকাতানি। তিনি জানান, তার দেশ বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার বিবেচনা করে। তবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও শ্রম পরিবেশ উন্নয়নের বিষয়ে তারা নিশ্চিত হতে চান। জবাবে উপদেষ্টাকে জানানো হয়, পোশাক শিল্পে শ্রম কমপ্লায়েন্স অনেক আগেই হয়েছে। মানবাধিকার বিষয়েও বর্তমান সরকার যথেষ্ট সচেতন রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মুক্তবাণিজ্য নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের দিক থেকে দ্রুত আলোচনা শুরুর তাগিদ ছিল। জাপানের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমরা এরই মধ্যে একটি ট্রেড নেগোসিয়েশন কমিটি গঠন করেছি। জাপানকেও বলেছি, একই ধরনের একটি কমিটি গঠন করতে, যাতে উভয়পক্ষ যৌথভাবে বসে চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অগ্রাধিকার খাতগুলো নির্বাচন করতে পারে।

সূত্র জানায়, জাপানের সঙ্গে দুই ধরনের বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখছে সরকার। এর একটি হচ্ছে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং অপরটি অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ)। এর মধ্যে যেটি লাভজনক হয় সে চুক্তির দিকেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। দেশটির সঙ্গে এ দুই চুক্তির যে কোনো একটি সম্পাদন করার লক্ষ্যে ডিসেম্বরেই যৌথ সমীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক এ কার্যক্রম শুরুর পর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার আগেই আমরা যেন একটি চুক্তি করতে পারি, সে লক্ষ্যেই যৌথ সমীক্ষা শুরু হলো। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব যাতে না পড়ে, সে লক্ষ্যেই এ চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানান, জাপান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন অংশীদার। গত পাঁচ দশকে দেশটি বাংলাদেশকে নানাভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। বিশেষ করে জাপান বাংলাদেশে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে যা বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশেষভাবে সাহায্য করছে। জাপান এখন বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজারও। ইউক্রেন যুদ্ধের পরও যে কয়েকটি দেশে রপ্তানি বাড়ছে, তার মধ্যে জাপান উল্লেখযোগ্য। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে জাপানে ৪২ দশমিক ৩২ শতাংশ। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগও বাড়ছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জাপানি বিনিয়োগ এসেছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সুবিধা জাপানের অনুকূলে থাকলেও দেশটির সঙ্গে মুক্তবাণিজ্যের বিষয়ে বাংলাদেশই বেশি আগ্রহী। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ জাপানে ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে, বিপরীতে দেশটি থেকে একই সময়ে ২ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। ফলে দেশটির সঙ্গে মুক্তবাণিজ্যে বর্তমানের লাভ-ক্ষতির তুলনায় ভবিষ্যতে বাণিজ্য সম্প্রসারণকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত যেসব দেশ রপ্তানি বেশি করে সেসব দেশই মুক্তবাণিজ্য থেকে লাভবান হয়- এমন একটি প্রচলিত ধারণা আছে। সে ক্ষেত্রে জাপানের সঙ্গে এফটিএ করলে তারা বেশি লাভবান হবে, কারণ তারা যে পরিমাণ করমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুযোগ পাবে বাংলাদেশ পাবে তার চেয়ে কম। তবে এ ধারণা নিয়ে বসে থাকার সময় নয় এখন। কারণ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এসব দেশে এমনিতেই আর শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া যাবে না। সে সময়ের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে যেতে হবে। এ ছাড়া এপটিএ স্বাক্ষরের পর জাপানি প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশি শিল্পপণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন করতে হবে। এটি বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ খবর