বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

উৎস বন্ধে নেই দৃশ্যমান উদ্যোগ

বায়ুদূষণের শীর্ষেই থাকছে ঢাকা

শামীম আহমেদ

উৎস বন্ধে নেই দৃশ্যমান উদ্যোগ

অক্টোবর থেকেই ভয়াবহ বায়ুদূষণের কবলে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। প্রায়ই দূষণের শীর্ষে উঠে আসছে জনবহুল এ নগরীর নাম। দিনের কখনো কখনো এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার বাতাসের দূষণ স্কোর ৪৪০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যাকে মানবস্বাস্থ্যের জন্য চরম বিপজ্জনক বিবেচনা করা হয়। দূষণের কারণগুলো বহুবার চিহ্নিত হলেও মাঝেমধ্যে রাজধানীর কিছু সড়কে পানি ছিটানো ছাড়া দূষণের উৎস বন্ধে নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ। ফলে রাজধানীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কালো ধোঁয়া ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি, খোলা ট্রাকে ধুলা উড়িয়ে পরিবহন হচ্ছে বালু-সিমেন্ট, আইন অমান্য করে ধুলা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলছে সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজ, সড়ক দখল করে রাখা হচ্ছে ইট-বালু-সুরকি।

এদিকে দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র বহুবার সড়কে আবর্জনা ফেললে ও নির্মাণসামগ্রী রাখলে জেল-জরিমানার কথা বললেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। পুরো রাজধানীর অধিকাংশ অলিগলি এখন নির্মাণসামগ্রীর দখলে। এগুলো ছড়িয়ে পড়ছে পুরো রাস্তায়। তার ওপর দিয়ে ধুলা উড়িয়ে ছুটে চলছে যানবাহন। সরকারি-বেসরকারি নির্মাণ এলাকাগুলোয় পানি না ছিটানোয় পুরো এলাকা সবসময়ই থাকছে ধূলিময়। ভোরবেলা পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সড়কগুলো ঝাড়ু দিয়ে অনেক স্থানে আবর্জনা স্তূপ করে রাখছেন, যা পরে আবারও সড়কে ছড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া মূল সড়ক ও অলিগলির পাশে বিভিন্ন দোকান থেকে সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে রাস্তায়, যা পরে ধুলায় পরিণত হচ্ছে। রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনে দিয়েই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী অসংখ্য যানবাহন, যেগুলোর ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজুয়ালের তথ্যমতে, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়ও ঢাকা ছিল বিশ্বের তৃতীয় দূষিত বায়ুর শহর। এ সময় বায়ুমান সূচকে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ১৬৪, যাকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি পিএম-২.৫ (অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা) ছিল ৭৯.৯ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া নিরাপদ সীমার (বার্ষিক গড়) চেয়ে ১৬ গুণ বেশি। দুই দিন আগে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় একিউআই স্কোর ছিল ২৫৮, যাকে চরম অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টায় ঢাকার বাতাসের একিউআই স্কোর ছিল ৪৪৫, যাকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ সময় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম-২.৫ ছিল ৪১৭.৬ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া নিরাপদ সীমার (বার্ষিক গড়) চেয়ে ৮৩ গুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শুধু বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের তীব্র সংক্রমণসহ নানান কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়।

এদিকে বিআরটিএর খাতা-কলমের তথ্যানুযায়ী তারা প্রতি মাসে যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। গত জানুয়ারিতে ৯৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ফিটনেসবিহীন ১৫টি যানবাহন ডাম্পিং করেছে। ৭২২টি মামলা ও ২৪ লাখ ১০ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা করেছে। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য বলছে, তারা সারা দেশে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। সর্বশেষ ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউ, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, বংশাল ও খিলগাঁওয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে কালো ধোঁয়া দূষণের দায়ে ১৭টি যানবাহন এবং নির্মাণসামগ্রী খোলা অবস্থায় রেখে বায়ুদূষণের দায়ে ছয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে জরিমানা আদায় করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, ‘বায়ুদূষণ কমাতে ডিএনসিসির আওতাধীন পুরো এলাকার মহাসড়ককে দুটি ভাগে ভাগ করে এক দিন অন্তর অন্তর দুটি স্প্রে ক্যানন দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে। অন্য সড়কগুলোয় ১০টি ওয়াটার ব্রাউজার দিয়ে সকালে ও বিকালে পানি ছিটানো হয়। আঞ্চলিক কর্মকর্তারা দূষণের উৎস বন্ধে অভিযান চালাচ্ছেন।’ তবে রাজধানীর মাত্রাতিরিক্ত দূষণপ্রবণ এলাকা মহাখালী, আবদুল্লাহপুর, গাবতলীর দোকানদারদের ভাষ্যানুযায়ী কিছু প্রধান সড়কে পানি ছিটাতে দেখেছেন, তবে ধুলা সৃষ্টিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান দেখেননি। বাড্ডা, রামপুরা, বেরাইদসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তারা জানান, ধুলা নিয়ন্ত্রণে তাদের এলাকায় কোনো ব্যবস্থা বা অভিযান তারা দেখেননি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের ফেলো ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ঢাকায় অনেক বড় প্রকল্প চলছে, ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ চলছে, ইটভাটার দূষণ আছেই, সম্প্রতি গাড়ির ধোঁয়ার দূষণও বেড়েছে। কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে বা নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। শহরের মধ্য দিয়ে উন্মুক্ত ট্রাকে বালু নিয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নেই। যারা দূষণ ঘটাচ্ছে, ব্যক্তি পর্যায় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় বা শিল্পকারখানা, প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে। যত দিন জনস্বাস্থ্যের জন্য যারা ঝুঁকি তৈরি করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা না যাবে, তত দিন দূষণ বন্ধ হবে না।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর