বুধবার, ১ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঘটনার আড়ালে অন্য ঘটনা

১২২ মামলায় অভিযোগের সঙ্গে নেই মিল, উঠে এলো পিবিআইর তদন্তে

মাহবুব মমতাজী

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) পাঁচ বছরে তদন্ত করা ১ হাজার ৯টি মামলার মধ্যে ১২২টিতে ভিন্ন ঘটনার তথ্য খুঁজে পেয়েছে। এসব মামলায় যেসব অভিযোগ করা হয়েছিল তার সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। ধর্ষণের অভিযোগে দেশের বিভিন্ন থানায় এসব মামলা হয়েছিল।

পিবিআইয়ের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা মামলায় তদন্তে ওই ১২২টিতে ধর্ষণের কোনো সত্যতা পাননি তাদের তদন্ত কর্মকর্তারা। এ ছাড়াও আরও ৮৮টি মামলায় তারা পেয়েছেন আইন বা তথ্যের ভুল।

পিবিআইয়ের তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী থানায় হওয়া মামলাগুলোকে জেনারেল রেজিস্ট্রার বা সংক্ষেপে জিআর মামলা বলা হয়। ধর্ষণের অভিযোগে হওয়া বিপুল সংখ্যক জিআর মামলা তদন্ত করেছে পিবিআই। তাতে দেখা যায়, এগুলোর বড় অংশ ভুয়া অভিযোগে করা। পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে, প্রেমের সম্পর্কের পর বিয়েতে রাজি না হওয়ায় বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতির কারণে অনেক মামলা হয়। প্রচলিত ও প্রযুক্তিগত তদন্তে সেসবে উল্টো ঘটনা ধরা পড়ে। একইভাবে আদালতে করা কমপ্লেইন রেজিস্ট্রার বা সিআর মামলার তদন্তেও প্রচুর অভিযোগের তদন্তে উল্টো ঘটনা বেরিয়ে এসেছে।

জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার এ প্রতিবেদককে বলেন, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায় একটা সম্পর্কের বন্ধনে থেকেছেন। পরে কোনো কারণে মতবিরোধ বা বিচ্ছেদ হয়েছে। এরপরই ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টাও থাকে। এসব ক্ষেত্রে ধর্ষণ প্রমাণ না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রমাণ ও যুক্তিসাপেক্ষ হওয়ায় আদালত তা গ্রহণ করেন। তবে দুজনের এরূপ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি ভুক্তভোগী আসলেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে আমরা আমাদের মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে ভুক্তভোগীকে আইনগত সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালে নিষ্পত্তি না হওয়া ৯১টিসহ ধর্ষণ-সংক্রান্ত মোট ২১৯টি মামলা তদন্ত করে পিবিআই। এর মধ্যে ৩৪টির উল্টো ঘটনা প্রমাণ হয়েছে। আইন বা তথ্যের ভুল ছিল ১৫ মামলায়। ২০২০ সালে তদন্ত করা ধর্ষণ মামলা ছিল ২৪১টি। এর মধ্যে ২০টি ছিল মিথ্যা তথ্য দিয়ে করা মামলা, তথ্যের ভুল ছিল ১৫টির। ২০১৯ সালে তদন্ত করা ২৫২ মামলার মধ্যে মিথ্যা তথ্য ছিল ২৩টিতে। আর তথ্যের ভুল পাওয়া গিয়েছিল ২০ মামলায়। ২০১৮ সালে পিবিআই মোট ১৬৪টি ধর্ষণ মামলা তদন্ত করে। এর মধ্যে ২৭টিতে পাওয়া যায় মিথ্যা তথ্য এবং ২২টিতে ছিল তথ্যগত ভুল। ২০১৭ সালে এমন মামলার সংখ্যা ১৩৩টি। এর মধ্যে ১৮টি ছিল মিথ্যা তথ্য দিয়ে করা মামলা। আইন বা তথ্যের ভুল ছিল ১৬টি মামলায়। পিবিআই সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পরিচালক ড. নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন এক নারী। মামলায় নুরুলের বাগানবাড়িকে ঘটনাস্থল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরে তদন্ত কর্মকর্তারা জানতে পারেন, জায়গাটি আসলে কলাবাগান এবং সেখানে একটি ছোট টিনশেড ঘর আছে। ওই ঘরে কেয়ারটেকার জহিরুল ইসলাম থাকেন। তবে অভিযোগকারী ওই বাড়িতে কখনো যাননি। এমনকি বাদী যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেই ঠিকানায়ও তিনি কখনো থাকেননি। মামলায় দেওয়া তার মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়। একই বছরের ১৬ আগস্ট আরেক নারী গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একই ব্যক্তি অর্থাৎ নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় ঘটনাস্থল বলা হয় নুরুলের অফিস ‘বাংলাদেশ-নরওয়ে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার’। অথচ সেখানে ধর্ষণের ঘটনা বা সন্দেহজনক গতিবিধি কেউ দেখেননি। আবার মামলার বাদীকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাদী ও বিবাদীর মোবাইল নম্বরের কললিস্ট চেক করে দুজনের কথোপকথনের প্রমাণও মেলেনি। ফলে ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। এরপর ২১ আগস্ট গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ এ একই আসামির বিরুদ্ধে আরেকটি যৌতুক মামলা হয়। পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে আসে- ভিন্ন নাম ব্যবহার করা হলেও তিনটি মামলার বাদী একজনই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর