শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

কথায় কথায় তালাক বাড়ছে

বিচ্ছেদে অনাগ্রহী পুরুষ, যারা এক-দুই বছর সংসার করেছেন এবং সন্তান নেই তারাই বেশি বিচ্ছেদে যাচ্ছেন

জিন্নাতুন নূর

কথায় কথায় তালাক বাড়ছে

বিবাহ বিচ্ছেদের খরচ বাড়লেও বিচ্ছেদের হার কিন্তু কমেনি। উল্টো কথায় কথায় জীবনসঙ্গীকে তালাক বা বিচ্ছেদ দেওয়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কমবেশি একই কারণ উল্লেখ করে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, ঢাকায় প্রতি তিন ঘণ্টায় চারটি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। সমাজবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছেন, মানুষের মধ্যে আগের চেয়ে সহনশীলতা কমে যাওয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে। এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পাওয়ার পর সিটি করপোরেশনের নোটিসে যে শুনানি ডাকা হয় সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে নারীদের তুলনায় পুরুষরা বেশি আসছেন। অর্থাৎ পুরুষরা বিবাহ বিচ্ছেদে আগ্রহী কম। দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, যারা মাত্র এক-দুই বছর সংসার করেছেন এবং যাদের সন্তান নেই তারাই বেশি বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। আর শালিসের মাধ্যমে সংসার টিকছে এমন হার খুবই কম।

বিয়ের পাঁচ মাস না যেতেই বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্রী নাজমুন আরা (ছদ¥নাম) তার বাবার বাড়ি এসে আর শ্বশুড়বাড়ি ফিরে যাননি। তিনি বাবার বাড়ি থেকেই বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন। মা-বাবা নাজমুনকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও নাজমুন তার প্রাক্তন স্বামী শফিকের সঙ্গে আর সংসার করবেন না- এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে নাজমুন জানান, প্রবাসী বরের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য বেশি। এ ছাড়া দুজনের রুচিবোধ এক নয়। নাজমুন স্বাধীনচেতা, আর শফিক চান তার স্ত্রী ঘর-সংসারে মনোযোগী হোক। স্ত্রী চাকরি করবেন এমন নাজমুনের স্বামীর পছন্দ ছিল না।

প্রসঙ্গত, আগে কেউ বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাইলে ডিভোর্স ইন্সট্রুমেন্টে স্ট্যাম্প ডিউটি ৫০০ টাকা দিতে হতো। কিন্তু এখন বাড়তি দেড় হাজার টাকা যোগ হয়ে মোট দিতে হয় ২ হাজার টাকা। কিন্তু বিষয়টি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনকারীদের সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা প্রভাব ফেলছে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অঞ্চল ৫ ও ৮-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি, স্ত্রীকে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং ভরণপোষণ দেওয়া হচ্ছে না- এমন কারণ দেখিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করা হচ্ছে। নারীদের ক্ষেত্রে তারা আগের তুলনায় বেশি স্বাধীনচেতা হওয়ায় এবং স্বাবলম্বী হওয়ায় বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা শুনানির জন্য যখন দুই পক্ষকে ডাকছি তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো পক্ষই উপস্থিত হচ্ছেন না। এর মধ্যে নারীদের উপস্থিতির হার খুবই কম। দেখা যাচ্ছে, ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জন উপস্থিত হচ্ছেন। ২ থেকে ৩ শতাংশ ক্ষেত্রে হয়তো উভয়পক্ষই শুনানিতে আসেন। এ ক্ষেত্রে নারীরা বিচ্ছেদের আবেদন করলে দেখা যায়, পুরুষরা শুনানিতে সংসার করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখান। সাধারণত দেখা যায়, যারা মাত্র এক-দুই বছর সংসার করেছেন এবং যাদের সন্তান নেই তারাই বেশি তালাকের আবেদন করছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) আবদুল্লাহ আল বাকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি গুলশান, বনানীর মতো বিলাসবহুল অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করছি। এ জন্য এখানে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণগুলো দেশের অন্য এলাকার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। সাধারণত এই এলাকার মানুষ সচ্ছল এবং তাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুশাসন দেশের অন্য এলাকার চেয়ে তুলনামূলক কম হয়। যা বিচ্ছেদ বেশি হওয়ার পেছনে কারণ হতে পারে। তবে সর্বোপরি চিন্তা করলে বলতে হয়, মানুষের মধ্যে সহনশীলতা আগের চেয়ে কমে এসেছে। একই সঙ্গে মানুষের মানিয়ে নেওয়ার যে ট্রেন্ড তাও কমে এসেছে। যা বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম একটি কারণ। যারা আমাদের কাছে আসেন তারা সাধারণত এই বিচ্ছেদ চান না। এ ক্ষেত্রে আমাদের কাছে পুরুষরা নারীদের তুলনায় বেশি আসছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হিসাব বলছে, নারীরা বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিগত কয়েক বছরে রেকর্ড গড়েছেন। নারীরা দ্বিগুণের বেশি হারে এখন বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। পুরুষরা এ ক্ষেত্রে বিচ্ছেদে আগ্রহ তুলনামূলক কম দেখাচ্ছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) হিসাবে, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১২ বছরে ঢাকা উত্তরের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট ৫৮ হাজার ৩০টি বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৭৯২টি আবেদন করেছেন নারীরা। আর পুরুষরা করেছেন ১৮ হাজার ৬৬৪টি। একইভাবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) গত তিন বছরে বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে ২১ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৯৯৪টি আবেদন করেছেন নারীরা। আর ৬ হাজার ২৯৪টি আবেদন করেছেন পুরুষরা।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তালাকের কারণগুলো ঘুরেফিরে একই হয়। এর মধ্যে আছে, স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, স্ত্রীকে ভরণপোষণ না দেওয়া, সন্দেহ করা, স্বামীর মাদকাসক্তি, স্ত্রীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌতুক দাবি, স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, অবাধ্য হওয়া, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি ইত্যাদি। উচ্চশিক্ষিত দম্পতিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করার কারণে সংসারে অশান্তি তৈরি হয়। যা শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য নারী নিজেই এখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ সময়ে এসে পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে অনেকে নিজের পেশাজীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে আগের চেয়ে বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।

সাড়া মেলে না বিচ্ছেদ নোটিসে : ঢাকার কয়েকজন নিকাহ রেজিস্ট্রার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রাজধানীতে প্রতি বছরই বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শালিসের মাধ্যমে সংসার টিকছে এমন হার খুবই কম। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করার ৯০ দিনের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ শালিসি বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু যারা আগে থেকেই বিচ্ছেদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তারা এই বৈঠকে আসেন না। আবার বাধ্যতামূলক না হওয়ায় এসব শুনানিতে সাড়াও কম মেলে। নোটিস পাওয়ার পরও অনেক সময় উভয় পক্ষ অনুপস্থিত থাকেন। দেখা যায়, স্ত্রীর আবেদনের নোটিসে কখনো স্বামী উপস্থিত থাকেন না, আবার কখনো স্বামীর নোটিসে স্ত্রী আসেন না। ফলে উভয়ের মধ্যে যে বিবাদ হয় তার মীমাংসা হচ্ছে না। এতে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর