বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
র‌্যাব হেফাজতে মৃত্যু

জেসমিনের মৃত্যু নিয়ে ছয় দিনেও মামলা হয়নি

নওগাঁ প্রতিনিধি

জেসমিনের মৃত্যু নিয়ে ছয় দিনেও মামলা হয়নি

র‌্যাবের হেফাজতে নওগাঁর চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামে এক সরকারি কর্মচারীর মৃত্যুকে ঘিরে বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। সৃষ্টি হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। এদিকে ২২ মার্চ সকাল সোয়া ৯টার দিকে র‌্যাব জেসমিনকে আটক করে নিয়ে যায় আর দুপুর সোয়া ১টার দিকে স্বজনরা জানতে পারেন তিনি হাসপাতালে। তাহলে র‌্যাব তুলে নেওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়ার আগে এই চার ঘণ্টা কোথায় রাখা হয়েছিল তাকে এমন তদন্ত দাবি করেছেন স্বজনরা। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ১৯ মার্চ সুলতানা জেসমিন সকালে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) এনামুল হকের অফিসের সামনে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টার মধ্যে তার পরিচয় ব্যবহার করে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেন। অথচ নওগাঁর চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা কাজী রফিউল আলম বলছেন অন্য কথা। তিনি ওই দিন সকাল ৯টায় অফিসে এসে হাজিরা খাতায় সই করে যথানিয়মে ৪টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এদিকে মৃত্যুর পরদিন জেসমিনকে শহরের সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরিবারের সদস্যরা ওই দিনই অভিযোগ করেন, র‌্যাব হেফাজতে নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে।

পরিবারের দাবি, আটকের আগে জেসমিনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। এ ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন জেসমিনের স্বজনরা। তারা এখন এ বিষয়ে খুব বেশি কথা বলতে চাইছেন না। কথা বলতে চান না জেসমিনের প্রতিবেশী ও সহকর্মীরা। এদিকে জেসমিনের একমাত্র ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন। সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তিনি কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। জেসমিনের ছোট ভাই সোহাগ হোসেন এবং ভগ্নিপতি রফিকুল ইসলামও কোনো কথা বলছেন না।

মামলার এজাহারে বলা হয়, চাঁদপুরের হাইমচর থানার গাজীবাড়ী এলাকার বাসিন্দা আল আমিন ও নওগাঁর সুলতানা জেসমিনসহ অজ্ঞাতনামা দুই-তিনজন যুগ্ম-সচিব এনামুল হকের নাম ও পদবি ব্যবহার করে ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন লোককে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। জেসমিনের মামা নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু জানান, সুলতানা ১৭ বছর আগে স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছিলেন। বাবা-মা কেউ নেই। এক ভাই ও বোন রয়েছেন। তার এই মৃত্যু পারিবারিকভাবে মেনে নেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। এটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু মানতে তারা নারাজ।

তিনি বলেন, ‘১৫ বছর ধরে ভূমি অফিসে চাকরি করছিলেন জেসমিন। তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ কতটুকু সত্য তা আমরা জানি না। আটকের এক দিন পর সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে এনামুল হকের মামলার বিষয়টি জেনে অবাক হয়েছি। কারণ জেসমিনকে আটকের ঘটনা ঘটেছে ২২ তারিখ কিন্তু মামলা হয়েছে ২৩ তারিখ। অভিযোগকারী এনামুল হককে কোনো দিন আমরা দেখিনি। এনামুলের সঙ্গে জেসমিনের কোনো ধরনের পরিচয় ছিল কি না সেটিও আমার জানা নেই।’

নাজমুল হক মন্টু বলেন, ২২ মার্চ যথারীতি সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে অফিসের উদ্দেশে রওনা হন জেসমিন। মুক্তির মোড় নওজোয়ান ঈদগাহ মাঠের কাছে পৌঁছালে একটি সাদা গাড়িতে করে সাদা পোশাকের র‌্যাব সদস্যরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যান। কয়েক ঘণ্টা খোঁজ করে পরিবারের লোকজন কোনো সন্ধান পাননি। অবশেষে দুপুর দেড়টার দিকে অসুস্থ অবস্থায় নওগাঁ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করে দেয় র‌্যাব। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হৃদরোগ বিভাগে নিয়ে চিকিৎসাসেবা শুরু করেন চিকিৎসকরা। ওই দিন বেলা ৩টায় অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রাত ৯টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা শুরু হয়। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ মার্চ সকাল ১০টায় চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অথচ জেসমিনের আগে থেকে কোনো অসুস্থতা ছিল না। শহরের জনকল্যাণপাড়ায় জেসমিনের ভাড়াবাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘জেসমিন ভালো মেয়ে ছিলেন। আমি যতদূর জানি টাকা-পয়সার কোনো লোভ ছিল না তার। এটা কেন হলো তা আমার বোধগম্য নয়। তার মতো নারী অন্যের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে চাকরি দেওয়ার নাম করে মানুষকে প্রতারণা করবেন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী মোমেনা খাতুন বলেন, ‘আমি কয়েক মাস জেসমিনের সঙ্গে কাজ করেছি। তার সম্পর্কে কোনো অভিযোগ পাইনি। একজন ভালো কর্মচারী ছিলেন তিনি।’ চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা কাজী রফিউল আলম বলেন, ‘মানুষ হিসেবে জেসমিন খুবই ভালো ছিলেন। তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি।’ নওগাঁ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফয়সাল বিন আহসান জানান, সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা কোনো অভিযোগ নেই থানায়। মৃত্যুর পর ছয় দিন অতিবাহিত হলেও সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর বিষয়ে কোনো মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেননি স্বজনরা। রাজশাহী র‌্যাব-৫ অধিনায়ক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। মামলা হয়েছে। এটি আদালতের বিষয়।’

সর্বশেষ খবর