সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি

বুধবারের মধ্যে অস্থায়ী দোকান বসানোর সিদ্ধান্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি। গতকাল সংসদ সদস্য, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই ও ভোক্তা অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি অনুদান  দিয়েছেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে আইএফআইসি ব্যাংকে খোলা অ্যাকাউন্টেও অর্থ পাঠিয়েছেন অনেকে। ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা নগদ অর্থ না নিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ০২০০০৯৪০৬৬০৩১ (সঞ্চয়ী হিসাব) মাধ্যমে টাকা নিচ্ছেন। এতে এক দিনে অ্যাকাউন্টে প্রায় ২ কোটি টাকা যোগ হয়েছে।

এদিকে, বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আগামী বুধবারের মধ্যে পোড়া ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সেখানে অস্থায়ীভাবে বসতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই লক্ষ্যে শ্রমিকদের দ্রুত ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নিতে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট সব দফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র।

তিনি নিজে উদ্বোধন করে ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে বসার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বাস দিয়েছেন। পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের পশ্চিম পাশে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা এবং জরুরি কাজে ব্যবহৃত অস্থায়ী কেন্দ্র গড়ে তুলেছে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতি। সেখানে সকাল থেকে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিরা এসে অনুদান দেন।

সরজমিনে দেখা গেছে, গতকাল বেলা পৌনে ১১টার দিকে সেখানে আসেন আলেয়া নামের এক হিজড়া। তিনি হজে যাওয়ার জন্য ২ লাখ টাকা জমিয়েছেন। কিন্তু আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দুর্দশা দেখে হজে না গিয়ে ২ লাখ টাকা ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য তহবিলে জমা দেন।

এরপরে বঙ্গবাজারে উপস্থিত হন কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তার নেতৃত্বে ২৬ লাখ টাকা জমা দেওয়া হয় তহবিলে। এ সময় তিনি বলেন, আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম ১০ লাখ টাকা দেব। কুমিল্লা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদককে অনুরোধ করেছিলাম তোমরাও ১০ লাখ টাকা দাও। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বললাম তুমিও ৫ লাখ টাকা দাও। আমরা ২৫ লাখ টাকা তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমাদের প্যানেল মেয়রও ১ লাখ টাকা দিয়েছেন। আমরা ২৫ লাখ টাকার কথা বললেও ২৬ লাখ টাকা হস্তান্তর করেছি। এরপর বঙ্গবাজারে আসেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের এক দিনের বেতন ও ইফতারের খরচ বাবদ ২ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেন। অধিদফতরের পক্ষ থেকে মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিনের হাতে চেক তুলে দেন। এ সময় সফিকুজ্জামান বলেন, আমাদের অফিসার্স ও কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে থাকার জন্য আমাদের সদর দফতরের এক দিনের বেতন ও ইফতারের খরচের ২ লাখ টাকা তুলে দিয়েছি। এর একটাই কারণ, আমরা যে কাজগুলো করছি, তা অনেক ব্যবসায়ী মনে করেন তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমরা যে তাদের পাশে আছি, এ জন্য এটি একটি প্রতীকী অংশগ্রহণ। এখানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যেন ভালোভাবে ঈদের আনন্দ করতে পারে।

সবশেষে বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ২০ লাখ টাকা সহায়তা করেন হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ হিজড়া উন্নয়ন সংস্থা থেকে এই অনুদান দেওয়া হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি কাশ্মীর দিপালী হিজড়া বলেন, গত ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে আমরা তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলেছি। আজকে তাদের এই বিপদের সময় আমরা আমাদের এবারের ঈদের যেসব কেনাকাটা রয়েছে, সেই কেনাকাটা না করে আমরা আমাদের এই ব্যবসায়ী ভাইদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। সারা দেশ থেকে ২০ লাখ টাকা আমরা তুলেছি। সেই টাকা আজ তাদের কাছে দিতে এসেছি। তারা বেঁচে থাকলে আমরাও বেঁচে থাকব।

গুরু মা রাখি শেখ বলেন, আমরা মানুষের কাছ থেকে এক-দুই টাকা করে উঠিয়ে উঠিয়ে এই টাকা জমিয়েছি। এখন আমরা সেটা মানবতার কল্যাণেই দিয়ে দেব। অনুদান হস্তান্তরকালে ঢাকাসহ আশপাশের প্রায় শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এরপর বঙ্গবাজারে আসেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে ১ কোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা দেন।

এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সুদমুক্ত বা স্বল্প সুদে বিশেষ মেয়াদি ঋণ প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। গতকাল সংগঠনটির সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার এক বিবৃতিতে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়াও ডিসিসিআই সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনার জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন।

তবে এসব অর্থ ক্যাশ আকারে নেওয়া হয়নি, ব্যবসায়ীদের তহবিলের জন্য খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ডিপোজিটের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. নাজমুল হুদা। তিনি বলেন, এক দিনেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি প্রায় ২ কোটি টাকা দিয়েছেন। আমরা এর একটি টাকাও ক্যাশ বা হাতে নেইনি। ব্যবসায়ীদের জন্য যেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, সেই অ্যাকাউন্টে ডিপোজিট করে স্লিপ দিতে বলা হয়েছে। এফবিসিসিআই-সহ সব সংগঠন ও ব্যক্তিকে এটি বলা হয়েছে। তারা সেভাবেই টাকা জমা দিচ্ছেন। আরও টাকা জমা হলে প্রধানমন্ত্রীসহ সবার পরামর্শ নিয়ে এক চেকে কিংবা দুই চেকে টাকা উত্তোলনসহ বাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এদিকে, চারটি মার্কেটের পোড়া ধ্বংসস্তূপ সরানো এবং সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বসার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়ের শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা। বৈঠকে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে মেয়রকে যাবতীয় সহায়তা করার আহ্বান জানানো হয়। মেয়র এর উত্তরে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি শ্রমিক সংখ্যা আরও বাড়িয়ে, দিন-রাত কাজ করে আগামী বুধবারের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেখানে ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে বসার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলতে তার দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ সমিতির নেতাদের নির্দেশ দেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা অস্থায়ীভাবে বসার দিন তিনি নিজে গিয়ে উদ্বোধন করবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছেন। তবে অস্থায়ীভাবে ব্যবসায়ীরা বসলেও কালবৈশাখী ঝড়, বৃষ্টিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে- সেসব বিষয় নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে সমিতির সভাপতি মো. নাজমুল হুদা বলেন, মেয়রের সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আগামী বুধবারের মধ্যে বসার সুযোগ করে দিতে চাই। তবে সেখানে যারা বসবে, তারা অস্থায়ীভাবেই বসবে। কোনো স্থায়ী দোকান হোক কিংবা স্থায়ীভাবে বসুক, তা আমরা চাইব না। আর প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে সাড়ে ৩/৫ ফুট করে চৌকির সাইজ করতে বলা হয়েছে। এতে দোকান বা জায়গা বণ্টন নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না।

তবে গতকালও ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। বিকাল পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৪০০ জন ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিক ও কর্মচারীর নাম এন্ট্রি করা হয়েছে, এমনটি জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেলের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশন ও দোকান মালিক সমিতিও আলাদা আলাদা তালিকা করছে। সব তালিকা ক্রসচেক করার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অনুদানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা খতিয়ে দেখবেন। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানান, তালিকা করার বিষয়ে আমরা বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতিকে দায়িত্ব দিয়েছি। তারা দেখভাল করছেন, তবে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে আমরা ব্যবস্থা নেব। এখানে যারা সদস্য তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন কে থাকবে, কে থাকবে না। এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৯০০ ব্যবসায়ীর তালিকা করা হয়েছে।

এদিকে গতকালও ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে, আবার কোথাও বের হচ্ছে ধোঁয়া। এর মধ্যেই বর্জ্য অপসারণের কাজ করছেন শ্রমিকরা। ধ্বংসস্তূপ থেকে লোহা ও টিন কেটে অপসারণ করছিলেন সোলায়মান। তিনি বলেন, আগুনের তাপ এখনো যায় নাই। তার ওপর রোদের তাপ। তা থেকে আগুন ও ধোঁয়া বের হচ্ছে। এর ভিতর দিয়েই আমরা সরানোর কাজ চালাচ্ছি।

সর্বশেষ খবর