বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

যান্ত্রিক রিকশায় অনিরাপদ সড়ক

♦ হালকা যানে দ্রুতগতির মোটর লাগানোয় দুর্ঘটনা ♦ নিবন্ধন না থাকায় রাজস্ব ফাঁকি কোণঠাসা প্যাডেলচালিত রিকশা ♦ মালিক স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনীতিবিদরা

শামীম আহমেদ

যান্ত্রিক রিকশায় অনিরাপদ সড়ক

রাজধানীর মাদানি এভিনিউ। নতুন বাজার থেকে বেরাইদ পর্যন্ত সড়কটি দিয়ে প্রাইভেট কার, অটোরিকশা ও বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনে-রাতে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলে ব্যাটারিচালিত যান্ত্রিক রিকশা। ফাঁকা রাস্তায় এসব রিকশার গতি উঠে যায় ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত। গত ৬ এপ্রিল মাদানি এভিনিউতে কুকুর দেখে ব্রেক কষতে গিয়ে রাস্তার পাশে উল্টে যায় একটি যান্ত্রিক রিকশা। আহত হন দুই যাত্রী ও রিকশাচালক। গতকাল নির্মাণাধীন অনন্ত হোটেলের কাছাকাছি সড়কে একটি দ্রুতগতির রিকশা হঠাৎ বামে টার্ন নেওয়ায় পেছনে থাকা একটি মোটরসাইকেল ও দুটি রিকশার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সর্বোচ্চ শক্তিতে ব্রেক কষার কারণে বড় কোনো ক্ষতি না হলেও রিকশার মতো হালকা যানবাহনে অস্বাভাবিক গতির কারণে সড়কটিতে হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা।

পুরো রাজধানীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিপজ্জনক লাখ লাখ যান্ত্রিক রিকশা। এতে সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি এসব রিকশা নিবন্ধিত না হওয়ায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ-সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অটোমোবাইল বিভাগের প্রধান ও চিফ ইন্সট্রাক্টর প্রকৌশলী রহমত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যন্ত্রচালিত এসব রিকশা দ্রুত যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি চালকদের কষ্ট কমিয়েছে। তবে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, যানবাহন তৈরিতে ওজন, গতি, চাকার আকার, সাসপেনশন, ব্রেকিং সিস্টেম সবকিছু বিজ্ঞানসম্মতভাবে সমন্বয় করতে হয়। যন্ত্রচালিত রিকশায় ব্রেক, সাসপেনশন কিছুই ঠিক নেই। ওজন কম। যানবাহনের তুলনায় চাকা বড়। এই যানবাহন দ্রুতগতিতে চলার সময় যে গতি জড়তা তৈরি হয়, হঠাৎ ব্রেক করলে ভারসাম্য রাখতে পারে না। উল্টে যায়।

জানা গেছে, ২০১৭ সালে হাই কোর্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশনা দেন। পরের বছর ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রধান সড়কে চলাচল বন্ধ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। তবে এসব নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে প্রতিদিনই বাড়ছে এই রিকশার সংখ্যা। শুধু মাদানি এভিনিউ নয়, সরেজমিন রাজধানীর ভাসানটেক, মাটিকাটা, মিরপুরের পল্লবীসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে যান্ত্রিক রিকশার দাপটে কোণঠাসা প্যাডেলচালিত রিকশার চালকরা। রামপুরা এলাকার রিকশাচালক ষাটোর্ধ্ব জহিরুল ইসলাম বলেন, ৩৫ বছর ধরে রিকশা চালান। এখন ইঞ্জিনের রিকশার সঙ্গে পেরে ওঠেন না। যাত্রীরা তাড়াতাড়ি যেতে ইঞ্জিনের রিকশায় ওঠেন। বয়স বেশি হওয়ায় গ্যারেজ মালিক ইঞ্জিনের রিকশা দিতে চান না। সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে রাজধানীর প্রতিটি এলাকার মোড় এখন যান্ত্রিক রিকশার দখলে। মাঝে মাঝে উঠে যাচ্ছে মূল সড়কে। দ্রুতগতির ভারী যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। পুলিশ ও দুই সিটি করপোরেশন ২০১৮-১৯ সালের দিকে জোরেশোরে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযানে নামলেও করোনার কারণে থেমে যায়। পরে আর তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি। উল্টো করোনার মধ্যে কর্মসংস্থান হারানো অনেকেই রিকশা চালনাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ায় বেড়েছে রিকশা, যার বেশির ভাগই ইঞ্জিনচালিত। নিবন্ধন না থাকায় এসব অবৈধ রিকশা থেকে কোনো রাজস্বও পাচ্ছে না সরকার। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মাসোহারা দিয়ে চলছে এসব অবৈধ রিকশা।

এমনকি অধিকাংশ রিকশার মালিক স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল বাড়ায় এমনিতেই রিকশার যাত্রী কমেছে। অন্যদিকে ইঞ্জিনচালিত রিকশায় কষ্ট কম হওয়ায় প্রচুর মানুষ রিকশা চালানো শুরু করেছেন। গ্রাম থেকে এসে অভিজ্ঞতা ছাড়াই রিকশার হ্যান্ডেল ধরছেন যুবক থেকে বৃদ্ধ। এতে রিকশার সংখ্যাও বাড়ছে। সড়কে ১০টা রিকশায় যাত্রী থাকলে ৫০টি খালি রিকশা রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়ে থাকছে। অন্যদিকে যাত্রী কমে যাওয়ায় খরচ তুলতে রিকশা ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন চালকরা। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্নবিত্তের মানুষ। এদিকে ঢাকার দুই সিটিতে নিবন্ধিত রিকশা ৩ লাখের কম হলেও বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে রাজধানীতে রিকশা চলছে ১১ লাখের বেশি, যার বড় অংশই ইঞ্জিনচালিত। চার বছর আগেই বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। অবৈধ হওয়ায় এই বিপুলসংখ্যক রিকশা থেকে শত কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সেই সঙ্গে অসহনীয় হয়ে উঠছে যানজট পরিস্থিতি। এ ব্যাপারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অভিযান বন্ধ হয়নি। আজও সম্পত্তি বিভাগ থেকে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু রিকশা ডাম্পিং করা হয়েছে। এখন যে এলাকাগুলোয় রাতের বেলা রিকশা চার্জের জন্য রাখা হয়, আমরা ওখানে অভিযানে গুরুত্ব দিচ্ছি।

সর্বশেষ খবর