বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
বঙ্গবাজারে আগুন

খোলা আকাশের নিচে চৌকি বিছিয়ে ব্যবসা শুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক

খোলা আকাশের নিচে চৌকি বিছিয়ে ব্যবসা শুরু

রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেট ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হওয়ার আট দিন পর চৌকি পেতে জামাকাপড় বিক্রি শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। ঘটনাস্থলে বালু ও ইট বিছিয়ে মার্কেটের উপযোগী করা হলেও ওপরে নেই কোনো ছাউনি। বিদ্যুৎ কিংবা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও নেই। এমন বাস্তবতায় প্রখর রোদেই খোলা আকাশের নিচে চৌকি বসিয়ে এক হাতে ছাতা ধরে, অন্য হাতে মাল বিক্রি করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এ অবস্থায় কেউ কেউ বেঁচে থাকার যুদ্ধের কথা জানালেও হতাশায় বেশির ভাগ ব্যবসায়ী দোকান শুরু করেননি। দোকান না শুরুর পেছনে তারা চতুর্মুখী সংকটের কথা বলছেন। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা বেশির ভাগই পাইকারি ব্যবসায়ী। এই ছোট চৌকিতে বেশি মালামাল না ধরায় তারা ব্যবসা করতে পারবেন না। যদি চৌকির ওপরে কাপড়ের স্যাম্পল রেখে বিক্রি করেন, তাহলে গুদামের দরকার, যা এ মুহূর্তে তাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। এর সঙ্গে রয়েছে মালামালের সংকট। যে গার্মেন্টস ও কারখানা থেকে মালামাল আনতেন তারা, সেখানে লাখ লাখ টাকা বকেয়া। ফলে তাদের কাছে নতুন করে বাকিতে মালামাল চাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার দোকান খুললে সেই পাওনাদাররা টাকার জন্য এসে বসে থাকবেন। কেউ যদি আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা এনে মালামাল ওঠাতে চান, তাও সম্ভব নয়। কারণ রাতের বেলা মালামাল রাখবেন কোথায়। যদিও গুদাম ভাড়া নেন কেউ, তাহলেও মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য আলাদা লেবার লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা, রোদের যে তেজ, খোলা আকাশের নিচে ব্যবসা করতে গেলেই রং জ্বলে যাবে। ফলে এই নিঃস্ব দশাতে আবার লোকসান গুনতে হবে। তবে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী অনুরোধ করেছেন যত দ্রুত সম্ভব সহায়তা তহবিলের টাকা তাদের হাতে তুলে দিতে। তাহলে কিছুটা বেশি মালামাল তুলতে পারবেন। এদিকে বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পক্ষ থেকে ২ কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। পর্যায়ক্রমে সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ ও ছাউনির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। অস্থায়ী দোকান শুরু হওয়ায় সেখানে উৎসুক জনতার ভিড় দেখা গেছে। সেই সঙ্গে কিছু পুরনো ক্রেতাও দেখা গেছে, যারা তাদের পরিচিত ব্যবসায়ীদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পুড়ে ভস্মীভূত হওয়া বঙ্গবাজার মার্কেটের অর্ধেক জায়গায় ইট-বালু দিয়ে ওপরে সারি সারি চৌকি বসানো হয়েছে। একেকটি চৌকি একজন ব্যবসায়ীর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে নিচতলায় যারা ব্যবসায়ী ছিলেন, তারাই অল্প অল্প মালামাল নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। দেড় শতাধিক ব্যবসায়ী দোকান চালু করলেও বেশির ভাগ ব্যবসায়ী চৌকি বসিয়ে নিজের জায়গা দখলে রাখছেন। আদর্শ মার্কেট এখনো অপসারণ না করায় সেখানকার ব্যবসায়ীরা দোকান বসাতে পারেননি। অস্থায়ী দোকান শুরু করা বঙ্গবাজার মার্কেটের নিচতলার হাফসা গার্মেন্টস নামে ১১৬০ নম্বর দোকানের ব্যবসায়ী ওমর ফারুক বলেন, ‘আগুনে ৩০ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। গার্মেন্টস ও কারখানায় আরও ১০ লাখ টাকা ঋণ আছে। সব মিলিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে গেছি। এখন দোকান খুললে পাওনাদাররা ভিড় করবেন। তাই প্রথমে দোকান খুলতে চাইনি। পরে পাওনাদারদের সঙ্গে আলাপ করে, আগুনে সময় রক্ষা করা এক বস্তা মালামাল নিয়ে দোকান শুরু করেছি। এখন একটাই চিন্তা, পেটে ভাতে চলা।’

আদর্শ মার্কেটের নিচতলার সিয়াম ফ্যাশন নামে ২১১ ও ৩০০ নম্বর দোকানের মালিক মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘এখন তো আমাদের কিছু নাই। এই ছোট চৌকিতে নতুন করে কীভাবে ব্যবসা শুরু করব। এই জায়গায় স্যাম্পল হিসেবে কিছু মাল রাখা যাবে। বিক্রি করতে হলে তো গুদাম দরকার। আশপাশে গুদাম নিতে গেলে ১৫-২০ লাখ টাকা লাগবে। এই টাকা পাব কোথায়?’ পাশাপাশি লেবার নেওয়া, রোদে পোশাকের রং জ্বলে যাওয়া, তপ্ত রোদে খোলা আকাশের নিচে কাস্টমার না আসাসহ নানা সংকটের কথা তুলে ধরেন তিনি।

সুমনা গার্মেন্টসের মালিক মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘এটা মিথ্যা আশ্বাস। এটা আশ্বাসের কোনো কাতারে পড়ে না। আছে আর ১০ দিন। কীভাবে ব্যবসা করব? পাইকারি ব্যবসা তো আর এত দিন চলবে না। ঈদের পর এখানে বেড়া দেবে। এরপর বহুতল ভবন হবে। আমাদের চৌকি কেনা, এটাই ব্যর্থ।’ আয়ান গার্মেন্টসের মালিক আরিফ ব্যাপারী বলেন, ‘গতকাল বেলা ৩টা পর্যন্ত ৫০০ টাকা বিক্রি করতে পারছি। আগে লাখ লাখ টাকা বিক্রি করতাম। আর এখন হাজার টাকা বিক্রি হওয়াও কষ্ট।’ ছেলের জন্য ফুলপ্যান্ট কিনতে বেগমবাজার থেকে বঙ্গবাজারের পুড়ে যাওয়া মার্কেটে আসেন আনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘২০ বছর ধরে আমি এখান থেকে ছেলেদের জন্য কাপড় কিনি। একটা দোকান থেকে কাপড় নিতাম। সেই চাচার সঙ্গে মহব্বত হয়ে গেছে। কিন্তু যেই চাচার দোকান থেকে কাপড় কিনি, ওই চাচার দোকান পুড়ে গেছে। উনি কই বসছেন সেটাও খুঁজে পাচ্ছি না। চিনতেও পারছি না। এখানে আসছি ওনাকে খুঁজতে। ওনাকে পেলে ওনার দোকান থেকে আমার ছেলের জন্য কিছু কাপড় কিনব। আজকে না পেলে কালকে আবার আসব। এর পরও চাচাকে খুঁজব।’ গতকাল দুপুরে চৌকি পেতে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কার্যক্রম উদ্বোধন শেষে ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে সহায়তা ছাড়াও ঢাকা সিটি করপোরেশন মানবিকভাবে ২ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা দেবে। ঢাকা শহরকে আমরা ব্যবসাবান্ধব নগরী হিসেবে সবাই মিলে গড়ে তুলব। নিছক একটি দুর্ঘটনার জন্য যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে গেল সেটা যেন আর কোনো দিন না হয়। ভবিষ্যতে দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মোকাবিলা করার জন্য আমরা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্থায়ী কমিটি গঠন করে দিয়েছি।’

ঈদের পরে পূর্ণাঙ্গভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে উল্লেখ করে ডিএসসিসি মেয়র বলেন, ‘এখন থেকে পূর্ণোদ্যমে এখানে ব্যবসা পরিচালনা হবে। আমাদের এখানে পাঁচটি পরিত্যক্ত ভবন ছিল। সেগুলো আমরা সরিয়ে ফেলেছি। আরও একটি বাকি আছে। সেটাও আজকের মধ্যে হয়ে যাবে। আগে এখানে দোকান মালিকরা যেভাবে ব্যবসা করতেন তাদের সেভাবেই জায়গা দেওয়া হয়েছে। আমরা তালিকাভুক্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের তাদের নিজ নিজ জায়গায় বসিয়ে দিতে পারছি। আমরা ঈদের আগে যদিও পূর্ণভাবে তাদের ক্ষতিপূরণ করতে পারব না, কিন্তু ঈদের পর আমরা তাদের পূর্ণভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করব। সেটা কীভাবে করব তা ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মেয়র তাপস বলেন, আপাতত খোলা আকাশের নিচে দোকানিরা বসছেন। পর্যায়ক্রমে ত্রিপল ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাও হবে। ব্যবসায়ীরা রাতেও বসতে পারবেন। এ সময় কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি ও ব্যবসায়ীদের ইফতারের জন্য সাকিব আল হাসানের দেওয়া ২০ হাজার টাকা দেওয়া নিয়ে বিতর্কের কথা তুলে ধরেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যবসায়ী সাকিবের অনুদানের টাকা নিয়ে এসব কথা বলেছেন, তাকে আমরা চিনি না। তিনি আমাদের ব্যবসায়ীদের কেউ নন। আমরা তার এমন আচরণে অনুতপ্ত।’ প্রসঙ্গত, ডিএসসিসির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৩ হাজার ৮৪৫ জন। এর মধ্যে ভস্মীভূত চার মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ২ হাজার ৯৬১ জন। তাদের মধ্যে ৭০০ থেকে ৮০০ জন ব্যবসায়ী চৌকি বসিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ পাবেন। যদিও ডিএসসিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা অনুযায়ী সবাই অস্থায়ীভাবে চৌকি বসিয়ে এখানে ব্যবসা করতে পারবেন।

সর্বশেষ খবর