বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
ইতিহাস ঐতিহ্য

দখলমুক্ত হরিপুর জমিদার বাড়ি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

দখলমুক্ত হরিপুর জমিদার বাড়ি

ইতিহাস-ঐতিহ্যে ঘেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন হরিপুর জমিদার বাড়ি। যা হরিপুর বড়বাড়ি বা রাজবাড়ি নামেও খ্যাত। ১৮০০ শতাব্দীতে জমিদার কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরী এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। যদিও স্থানীয়দের মতে গৌরীপ্রসাদ রায় চৌধুরী ও কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরী যৌথভাবে তিন তলা এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। তিতাস নদীর পাড়ে প্রায় ৪৮০ শতক জমির ওপর ৬৫ কক্ষ নিয়ে নির্মিত এ জমিদার বাড়ি। হরিপুরের জমিদাররা ত্রিপুরার প্রভাবশালী জমিদারদের উত্তরসূরি ছিলেন। অবশেষে দীর্ঘ ৭৫ বছর পর গত ৫ মে দখলমুক্ত হলো হরিপুর জমিদার বাড়ির মূল অংশ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, আমরা পুরনো এই ঐতিহ্যকে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। এত দিন বেদখল থাকার কারণে সংস্কার কাজ করা যায়নি। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বাড়িটিকে দর্শনার্থীদের উপযোগী করে সংস্কার কাজ করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বাড়িটি সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় দেড় শ বছর পূর্বে ব্রিটিশ আমলে মনোরম নির্মাণশৈলীতে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। মেঘনা তথা তিতাসের পূর্বপ্রান্তে এত বড় বাড়ি আর কোথাও নেই। বাড়ির বাইরের অবয়বটি অবিকল রয়ে গেছে। কারুকাজ খচিত দেয়াল, স্তম্ভ ও কার্নিশ। এই জমিদার বাড়িটিতে প্রায় ৬০টি কক্ষ, রংমহল, দরবার হল, ধানের গোলা, গোয়ালঘর, রান্না ঘর, নাচ ঘর, মল পুকুর, খেলার মাঠ, মন্দির ও সীমানা প্রাচীর রয়েছে। বিশাল আয়তনের বাড়িটির পুরো ভবনের কোথাও কোনো রডের গাঁথুনি নেই। লাল ইট-সুরকির গাঁথুনি দিয়ে তৈরি ভবনের দুই পাশে দুটি সুউচ্চ গম্বুজ সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে, জমিদার বংশের ঐতিহ্যের কথা। দুই তলায় ওঠার ছয় দিকে ছয়টি সিঁড়ি ও তিন তলায় ওঠার দুই দিকে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। বাড়তি পশ্চিম-উত্তর কোণে ছয়টি বেড রুম এবং মল পুকুরের পূর্বপাড়ে চারটি ও পশ্চিম পাড়ে চারটি বেড রুম রয়েছে। বাড়ির পশ্চিম দিকে তিতাস নদীর পাড়ে পাকা ঘাটলার উত্তর দিকে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী ও দক্ষিণ দিকে গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরীর সমাধি মঠ রয়েছে। বাড়িটি দেখার জন্য এখনো দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন বনভোজনে আসেন। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে তিতাসে যখন পানি থইথই করে তখন বাড়িটির সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। ১৩৪৩ বাংলার ১২ চৈত্র (দোল পূর্ণিমা) তারিখে কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর পর্যায়ক্রমে বাড়িটির উত্তরাধিকার হন হরিপদ রায় চৌধুরী ও শান্তি রায় চৌধুরী। তাদের কাছ থেকে বাড়ির মালিকানা ও জমিদারি আসে উপেন্দ্র রায় চৌধুরী ও হরেন্দ্র রায় চৌধুরী। কালক্রমে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হওয়ার পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে তারা বাড়িটি ফেলে কলকাতায় চলে যান। জমিদাররা বাড়িটি ফেলে যাওয়ার সময় পুরোহিতদের রেখে যান। এর পর থেকে তাঁদের বংশধরদের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু মুসলিম পরিবার দখল নিয়ে বসবাস শুরু করেন সেখানে। সেই থেকে প্রায় ৭৫ বছর ধরে বাড়িটি ছিল বেদখলে। এতে জমিদারি প্রথার জানান দেওয়া বাড়িটি দিনের পর দিন বিলুপ্তির পথে যেতে থাকে। বর্তমানে বাড়িটি সংস্কারের অভাবে অনেকটাই জরাজীর্ণ। যদিও ২০১৭ সালে বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অধীনে যাওয়ার পর প্রায় ১১ লাখ টাকা ও ২০১৯ সালে ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই ধাপে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বাড়িটির মূল অংশ দখলদারদের দখলে থাকায় সে কার্যক্রম থমকে যায়। অবশেষে দীর্ঘ ৭৫ বছর স্থানীয়দের দখলে থাকার পর দখলমুক্ত হলো হরিপুর জমিদার বাড়ির মূল অংশ। সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়িটি দখলমুক্ত করতে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তবে এখনো দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত হয়নি জমিদার হরিপদ রায় চৌধুরীর স্ত্রীর স্নান করার পুকুরটি (ঘাটলাটি)। নাসিরনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জমিদার বাড়িটিতে ৫২টি পরিবার অবৈধ দখল নিয়ে বসবাস করত। বাড়িটি দখল মুক্ত করতে বেশ কয়েকবার তাদের নোটিস দেওয়া হয়। তারা দখল ছাড়তে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করে ৫২টি পরিবাকে মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই মধ্যে ৪১টি পরিবারকে উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ১১টি হিন্দু পুরোহিত পরিবার অন্যত্র জায়গাজমি কিনে বসবাস শুরু করেছেন। তবে তাদের আশ্রয়ণে ঘর দিতে চাইলেও তারা নিতে চায়নি। বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নিরাপত্তাকর্মী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বাড়িটির মূল অংশ দখলমুক্ত হলেও এখনো দখলদারদের কবলে রয়েগেছে জমিদারের স্ত্রীর স্নান করার পুকুরটি। ওই পুকুরের সিঁড়ির আশপাশে গোখড়া সাপের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের পক্ষ থেকে তিনজনকে এবং উপজেলা আনসার ভিডিপি ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ছয় সদস্যকে এখানে নিয়োগ করা হয়েছে। বাড়ি দখলমুক্ত হওয়ার পর গোখড়া সাপের আতঙ্কে দিন কাটছে। বাড়িটির আঙিনা পরিষ্কার করতে গেলেই চারদিকে বড়বড় গোখড়া সাপের দেখা মিলছে। এ পর্যন্ত ২০টি সাপকে তারা মেরেছেন। সাপের কামড়ে এই পর্যন্ত ছয়জন স্থানীয় বাসিন্দা মারা গেছেন বলেও তিনি দাবি করেন। সাপের ভয়ে ভবনের বাহিরে যেতেও ভয় পাচ্ছেন তারা। প্রসঙ্গত, নাসিরনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বাড়িটির অবস্থান।

 

সর্বশেষ খবর