শুক্রবার, ২৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

অ্যাসিড-সন্ত্রাসে উদ্বেগ কাটেনি

♦ অর্থাভাবে বন্ধ সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের সেবা ♦ ৯ শতাংশ মামলায় অভিযুক্ত অপরাধীর সাজা ♦ মাত্র ২ শতাংশ ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ পান

জিন্নাতুন নূর

অ্যাসিড-সন্ত্রাসে উদ্বেগ কাটেনি

বাংলাদেশ থেকে এখনো অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ কাটেনি। আগের তুলনায় অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমলেও সচেতনতার অভাব ও অপরাধীদের শাস্তি কার্যকরের হার আশানুরূপ না হওয়ায় ভয়াবহ এ অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যাসিড-সন্ত্রাসের অভিযোগে গ্রেফতার অপরাধীদের সাজা পাওয়ার হার কম। এমনকি এ জন্য সংশ্লিষ্ট আইনে ভুক্তভোগীর যে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা সেটিও তারা সেভাবে পাচ্ছেন না। উদ্বেগের বিষয়, অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও অর্থনৈতিক সাহায্যে নিয়োজিত অন্যতম প্রতিষ্ঠান অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) ফান্ডিং না থাকায় প্রতিষ্ঠানটিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে ভুক্তভোগীদের চিকিৎসাসহ অন্য সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা ঝুঁকিতে পড়েছেন। এ অবস্থায় নতুন করে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো সংশ্লিষ্টদের দুশ্চিন্তায় ফেলছে।

এএসএফের তথ্যে, ২০২২ সালে দেশে মোট ১৮টি ঘটনায় ২৯ জন অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হন। এর মধ্যে নারী ১৬ জন, পুরুষ ১১ জন এবং শিশু দুজন। এর আগে ২০২১ সালে ১৯ জন, ২০২২ সালে ২২ জন, ২০১৯ সালে ২১ জন এবং ২০১৮ সালে ২২ জন অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হন। সংগঠনটির তথ্যে, ১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে মোট ৩ হাজার ৪৬৯টি ঘটনায় ৩ হাজার ৮৭৩ জন অ্যাসিড হামলার শিকার হন। দেখা যায় পারিবারিক বিবাদ, জমি নিয়ে ঝামেলা, প্রেমে প্রত্যাখ্যান, আপত্তিকর সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক কলহ, যৌতুক চেয়ে না পাওয়া এবং বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মতো কারণে অপরাধীরা অ্যাসিড নিক্ষেপ করে। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। সাধারণত স্বামী, সাবেক স্বামী, পারিবারিক বন্ধু, প্রেমিক, প্রতিবেশী, ব্যবসায়িক প্রতিযোগী, আত্মীয় এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটান।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মাত্র ৯ শতাংশ অ্যাসিড-সংক্রান্ত মামলায় অভিযুক্ত অপরাধীদের সাজা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনকে মৃত্যুদ- দেওয়া হলেও একটিও কার্যকর হয়নি। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার হার খুব নগণ্য। আক্রান্তদের মাত্র ২ শতাংশ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। অ্যাসিডে আক্রান্তরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ অনুযায়ী ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার কথা। আইন অনুযায়ী হামলার শিকার নারীর ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। সম্প্রতি বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় চা-বাগানের এক তরুণীর ওপর চা-বাগানের কর্মী লাল চান বাউরী অ্যাসিড নিক্ষেপ করেন। দীর্ঘদিন উত্ত্যক্ত করার পর সেই তরুণীকে বাউরী বিয়ের প্রস্তাব দেন। এতে সাড়া না দিলে ১৪ মে সেই তরুণীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করেন তিনি। এতে তরুণীর ডান চোখ ও গালের অনেকাংশ পুড়ে যায়।

এ ছাড়া সম্প্রতি হত্যার পর লাশ যেন শনাক্ত না হয় এ জন্য এসএসসি পরীক্ষার্থী সিরাজ শেখের মাথার মাংস ব্যাটারির অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে দেন তার প্রেমিকার বাবা সবুর শেখ। ৬ মে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা ইউনিয়নের চরদৌলতপুর গ্রামে খুন হন সিরাজ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ জানায়, সম্প্রতি প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু অ্যাসিড-সংক্রান্ত মামলায় সাজা হয়েছে। কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা হচ্ছে আদালতে সাক্ষী হাজির করা। আবার মামলার দীর্ঘসূত্রতাও আছে। এসব মামলায় বিচার কার্যক্রম আশানুরূপভাবে হচ্ছে না। এ জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। অ্যাসিড-সন্ত্রাস বন্ধে সচেতনতামূলক প্রচার নেই বললেই চলে। একই সঙ্গে ভিকটিমদের বারবার প্রশ্ন করে মানসিকভাবে নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারেও সমাজকে সচেতন হতে হবে।

অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সরদার জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০১৮-১৯ অর্থবছরে এএসএফের বাজেট ছিল ৬ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি ছিল দেড় কোটি টাকা। করোনা শুরুর বছরে ২০২০ সালে এএসএফের হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় সংগঠনটির ২২ জন স্টাফ, যার অধিকাংশই অ্যাসিড ভিকটিম, তারা চাকরি হারান। এখন রাজধানীর আদাবরে আমরা সাময়িকভাবে বহির্বিভাগে কিছু রেফার্ড রোগী দেখছি। একজন অ্যাসিড ভিকটিমের ক্ষত সারতে বেশ কয়েকবার ফলোআপ রিকনস্ট্রাকটিভ ফলোআপ সার্জারি প্রয়োজন, যা এএসএফের হাসপাতাল বন্ধ থাকায় হচ্ছে না। কিন্তু ভিকটিমদের দীর্ঘ সময় চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও অর্থসাহায্য প্রয়োজন, যার সবই এখন বন্ধ। ফান্ড না থাকায় আগামী বাজেটে প্রতিষ্ঠান কীভাবে চালাব বুঝতে পারছি না। এখন শুধু ফোনে কিছু ভিকটিমকে আইনগত সহায়তা দিচ্ছি। আশঙ্কা করছি এমন চলতে থাকলে এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। অ্যাসিডের ঘটনা ঘটার পরও একজন ভিকটিমকে ফলোআপ সার্জারি ছাড়া বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতের চিকিৎসা করাতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের নিজস্ব ঠিকানা দরকার, যেখানে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলা যাবে। ২০ শয্যার একটি হাসপাতাল চালাতে এখন ২০ কোটি টাকার ফান্ড লাগবে।’ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা অনেকাংশে কমে এলেও এটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। আগে একটা সময় মেয়েরা প্রেমের সম্পর্কে সাড়া না দিলে অ্যাসিড ছুড়ে মারলেও দুর্বৃত্তরা এখন রাজনৈতিক, জমি-সংক্রান্ত সমস্যাতেও অ্যাসিড ছুড়ছে। আর অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার ব্যক্তিরা আজীবন এক দুর্বিষহ-জীবনযাপন করছেন। ভুক্তভোগীদের দেশে-বিদেশে যতই চিকিৎসা করানো হোক না কেন, আগের মতো অবস্থায় তার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।

 

সর্বশেষ খবর