রবিবার, ৪ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

সাত দফা অবস্থান শনাক্ত, তবু অধরা

পাহাড়ে জঙ্গিদের সংগঠিত করছেন জিয়া, অবস্থান কখনো সীমান্তে কখনো রোহিঙ্গা ক্যাম্প, কখনোবা গহিন অরণ্যে

সাখাওয়াত কাওসার

সাত দফা অবস্থান শনাক্ত, তবু অধরা

টানা ১১ বছর ধরে অধরা অভিজিৎ হত্যা মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়া ওরফে সৈয়দ মো. জিয়াউল হক জিয়া। এর মধ্যে অন্তত সাতবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেলেও তাকে পাকরাও করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে একাধিক সংস্থার সংশ্লিষ্টরা। আত্মগোপনে থেকেই পাহাড়ে জঙ্গিদের সংগঠিত করছেন জিয়া। সম্প্রতি সিলেট থেকে গ্রেফতার হওয়া নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুনের কাছ থেকে জিয়ার বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে র‌্যাব। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, মায়মুনের সিলেটের বাসায় মেজর জিয়ার আসা-যাওয়া ছিল। যদিও মানিকগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, আমাদের কাছে যতটুকু তথ্য আছে, ‘জিয়া’ দেশে নেই। অন্য দেশে গা-ঢাকা দিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব তাকে ধরে এনে রায় কার্যকর করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিয়া এখন সিলেট চট্টগ্রাম বিভাগের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে অবস্থান করছেন। এক্ষেত্রে নিজের নিরাপত্তার জন্য দুর্গম ও গহিন অরণ্য তার পছন্দ। তবে তিনি দীর্ঘ সময় এক জায়গায় অবস্থান করেন না। আগামী নির্বাচনে উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্যদের কাজে লাগানোর বিষয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে একটি মহল। এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও জিয়ার বিশেষ ভূমিকা থাকবে। জানা গেছে, গত ৮ মে রাতে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা দল ও র‌্যাব-৯-এর যৌথ অভিযানে সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার বড়শলা বাজার এলাকা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে। তারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পাশাপাশি পাহাড়ে শান্তি নষ্ট করতে তৎপর ছিল। এদের মধ্যে জঙ্গি আবদুল্লাহ মায়মুন এক সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের শীর্ষ স্থানীয়দের একজন ছিলেন। তিনি বর্তমানে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সেতুবন্ধনে কাজ করছিলেন।

র‌্যাব জানায়, গ্রেফতার মায়মুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের সিলেট বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ২০১৩ সালে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি প্রথমে আনসার আল ইসলাম জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন। তখন থেকেই মেজর জিয়ার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তার সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বাসায় জিয়ার যাতায়াত ছিল। পাহাড়ে জঙ্গিদের অবস্থান বাড়াতে তিনি অভিনব কৌশলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করে দিতেন।

মায়মুন ২০১৯ সালে বগুড়ার একটি সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় গ্রেফতার হন। এক বছরের অধিক কারাভোগ করে ২০২০ সালের শেষের দিকে জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মেজর (অব.) জিয়া দেশেই আছেন। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের গ্রেফতারের পর আমরা এ বিষয়টি জানতে পেরেছি। জিয়া নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে ১৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন।

কমান্ডার মঈন আরও বলেন, গত বছরের শেষের দিকে তিনি সিলেটের সীমান্ত এলাকায় ছিলেন। নানান ছদ্মবেশে তিনি গোপনে দেশে উগ্র-মৌলবাদ বিস্তার করছেন। তাকে গ্রেফতার করার সব ধরনের তৎপরতা অব্যাহত আছে।

গ্রেফতারকৃতদের উদ্ধৃতি দিয়ে র‌্যাব জানায়, ২০১৯ সালের শেষের দিকে রাজধানীর বাড্ডায় এক বন্ধুর বাসায় জিয়া কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। একই বছরে ময়মনসিংহের একটি বাসায়ও কয়েক মাস ছিলেন। সেখান থেকে টঙ্গীতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানেও যান। এরপর সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকায় বেশ কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহসহ কোনো কোনো এলাকায় জিয়া ঘোরাঘুরি করতেন তার একটি চিত্র তাদের হাতে ছিল। সেই হিসেবে অন্তত পাঁচবার তার খুব কাছ পর্যন্ত গিয়েও গোয়েন্দারা তাকে ধরতে পারেনি। এরপর জিয়া কিছুদিন চট্টগ্রামে অবস্থান করে তিনি সিলেটে চলে যান। সেখান থেকে টেকনাফ মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় কিছুদিন অবস্থান করেন। পাহাড়ে অবস্থানরত শীর্ষ কয়েকজন জঙ্গি এবং রোহিঙ্গা নেতৃত্বের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কমান্ডার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, শীর্ষ জঙ্গি নেতা জিয়াকে ধরার সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

গ্রামের বাড়িতে তালা : যুক্তরাষ্ট্র জিয়ার সন্ধানে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণার পর তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের শহরতলির মোস্তফাপুর ইউনিয়নে বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। মোস্তফাপুরে জিয়ার পৈতৃক বাড়ি। বাড়ির দুটি ঘরেই বাইরে থেকে তালা ঝুলছে।

জানা যায়, জিয়া মা-বাবার একমাত্র ছেলে। তার দুই বোন। প্রথম স্ত্রী ছিলেন তারই মামাতো বোন। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। প্রথম পক্ষের একটি সন্তান আছে। পরে আবার বিয়ে করেন পটুয়াখালীতে। এই পক্ষে দুটি সন্তান আছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হায়দার খুনের পর এবিটিতে জিয়ার সম্পৃক্ততা বিষয়টি উঠে আসে। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসে জিয়ার নাম। তবে এর আগে আসছিল আকরামের নাম। জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন আকরাম। পরবর্তীতে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলা এবং জুলহাস-তনয় হত্যা মামলায়ও জিয়ার নাম আসে। তিন মামলায়ই জিয়ার সঙ্গে আকরামও ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি। এবিটির তাত্ত্বিক নেতা মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানির ঘনিষ্ঠজন ছিলেন জিয়া। রাহমানি গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

২০১৬ সালে পুলিশ সদর দফতর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়, জিয়া আল-কায়েদাপন্থি জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, জিয়া ও তার ঘনিষ্ঠ আকরামসহ অভিজিৎ হত্যাকান্ডে জড়িতরা এখনো বাংলাদেশেই রয়েছে। তাদের সন্ধান চেয়ে গত বছর ৫০ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের অধীন রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস (আরএফজে)।

সর্বশেষ খবর