ছলিমা খাতুনের তিন সন্তান। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। স্বামী আবুল কাশেম স্থানীয় একটি ইটভাটায় চাকরি করেন। সাতকানিয়ার কেওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহনী গ্রামে চার কক্ষের কাঁচা বাড়ি ছিল। স্বামী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সেখানেই থাকতেন। সবকিছু ঠিকমতোই চলছিল। কিন্তু গত সপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তাদের মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু ভেসে গেছে। এখন তাদের ঠিকানা পাশর্^বর্তী দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন। স্লিপারের ওপর প্লাস্টিকের তাঁবু টাঙিয়ে দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে সেখানেই দিন যাপন করছেন ছলিমা।
হঠাৎ করে ভয়াবহ বন্যায় সৃষ্ট বিভীষিকাময় মুহূর্ত বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার কেঁদে উঠছিলেন তিনি। নিজের ঘরের নিশানা ও ভাঙা অংশ দেখিয়ে বলছিলেন, ‘এমন বৃষ্টি আমি জীবনে দেখিনি। পানি বেড়ে যাওয়ার পর কোনোমতে সাঁতরে রেললাইনের ওপর উঠি। রেললাইনের কারণে বেঁচে গেছি হয়তো। আবার রেললাইনের জন্যই নাকি বন্যা হয়েছে। পানি নেমে গেলেও ঘরে ফিরতে পারছি না। আমাদের বাড়ি বন্যায় নিয়ে গেছে। মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। তার বই, কাগজপত্র সব বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে।’ সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ছলিমার পরিবারের মতো এ রকম অন্তত ৫০টি পরিবার দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের ওপর আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেকের ঘর বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। যাদের ঘর আছে তারা আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরলেও ঘরহারা পরিবারগুলো ফিরতে পারছে না। এই রেললাইন তাদের কাছে অভিশাপের মতো। তেমনই আরেক বৃদ্ধা সেলিনা বেগম। যার বয়স সত্তরের কাছাকাছি। মনে আছে মুক্তিযুদ্ধের কথাও। ছেলে ও ছেলের ১০ জনের পরিবার নিয়ে তিনিও আশ্রয় নিয়েছেন রেললাইনে। তিনি বলছিলেন, ‘সবাই তো রেললাইনের পক্ষে। কিন্তু রেললাইনের জন্য যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। সরকার চাইলে এটা ঠিক করতে পারে।’ এদিকে পরিদর্শনের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন, ব্যবসায়ী দিদারুল আলমসহ আরও অনেকে। তাদের ভাষ্য, ব্রিটিশ আমল থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মানুষের স্বপ্ন ছিল একটি রেললাইন, যেটি চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আসবে। ব্রিটিশ গেল, ভারতবর্ষ ভাগ হলো, স্বাধীন বাংলাদেশের চার দশক ধরে সেই স্বপ্ন অধরা থেকে গেল। অবশেষে বর্তমান সরকার অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে এই প্রকল্পের কাজ শুরুর পর স্থানীয়দের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। কিন্তু এই বন্যা যে একদিন ‘নদী’তে পরিণত হতে পারে সেটা নিয়ে কিছু মানুষের মধ্যে শুরু থেকেই আশঙ্কা ছিল। দিদারুল আলম জানান, নির্মাণকাজ শুরু হলে স্থানীয়রা রেললাইনে বাড়তি ব্রিজ-কালভার্ট স্থাপনের দাবি জানান, আন্দোলন করেন। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলেছিল, পরিকল্পিত এই রেললাইন দিয়ে বন্যার উদ্ভব হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থানীয়দের ধারণা সত্যি হলো। বন্যায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হলো। এখন এখানকার বাসিন্দারা বৃষ্টি দেখলেই আতঙ্কিত বোধ করছেন। এই রেললাইন অভিশাপ হয়ে উঠেছে কিছু মানুষের কাছে। তবে ব্রিজ-কালভার্টের সংখ্যা বাড়িয়ে এই অভিশাপকে আশীর্বাদে পরিণত করা সম্ভব। সোমবার সরেজমিনে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন পরিদর্শনের সময় স্থানীয়রা দাবি করেন, বৃষ্টির পর পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে রেললাইনে পূর্বপাশ ফুলে ওঠে। রেললাইনের কারণে পানি পশ্চিমে সাগরের দিকে যেতে পারেনি। পশ্চিম পাশের সঙ্গে পূর্ব পাশের পানির ব্যবধান চার-পাঁচ ফুট হয়ে যায়। একপর্যায়ে পূর্ব পাশের পানি রেললাইনের ওপর দিয়ে উপচে পশ্চিম পাশে যেতে থাকে। এতে করে রেললাইনের পাথর সরে স্লিপার বেঁকে গেছে। যদিও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি, রেললাইনের কারণে বন্যা হয়নি। অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা হয়েছে। বন্যার সময় রেললাইনে পূর্ব ও পশ্চিম পাশের পানির স্তর সমান ছিল দাবি করে প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বন্যা হয়েছে অতিরিক্ত পাহাড়ি ঢলের কারণে, টানা বৃষ্টির কারণে। রেললাইনের কারণে যদি বন্যা হতো তাহলে বন্যার সময় রেললাইনের দুই পাশের পানি সমান হতো না।’ প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের এই প্রকল্প নেওয়া হয়। বর্তমানে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের ৮৮ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসে এই রেললাইন চালুর ঘোষণা দিয়েছে রেলওয়ে।