মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
পশ্চিমাঞ্চল রেল

কেনাকাটায় অর্থ লোপাট

দুই খাতে অডিট আপত্তি ২০ কোটি টাকার

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

কেনাকাটায় অর্থ লোপাট

পশ্চিমাঞ্চল রেলে উন্নয়ন প্রকল্পে কেনাকাটা ও হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের নামে ২০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এমন লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয় ও রেল হাসপাতালে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিট জেনারেলের অডিট প্রতিবেদনে দুই খাতে অর্থ লোপাটের উঠে এসেছে এমন চিত্র। প্রতিবেদনে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘অডিট আপত্তি চলমান প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই এগুলোর জবাব দেন ও নিষ্পত্তি করেন। ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অধীন ঈশ্বরদী-ঢালারচর নতুন রেলপথ নির্মাণে প্রকল্পের পরিশোধিত বিল-ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০১২-১৩ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চুক্তি সম্পাদনকালে এনবিআরের আদেশ মোতাবেক সাড়ে ৫ শতাংশ এবং আয়কর পরিপত্র অনুযায়ী ৫ শতাংশ ভ্যাট কর্তন করা হয়। কিন্তু ২০১৬-১৯ তিন অর্থবছরে এনবিআরের নির্দেশনায় ৬ শতাংশ ও আয়কর পরিপত্র অনুযায়ী পরিবর্তিত হারে ৭ শতাংশ কাটা হয়, যা পরে সম্পূরক চুক্তি সম্পাদন করে ওই অতিরিক্ত কর্তন হিসেবে দেখানো ভ্যাট ও আয়করের অর্থ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল আকারে অনিয়মিতভাবে ফেরত প্রদান করা হয়েছে। এতে সরকারের ১১ কোটি ৮ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৫ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। অথচ সরকারের রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত ভ্যাট ও আইটির অর্থ প্রকল্প পরিচালকের ফেরত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ওই অনিয়ম করেছেন। ঢালারচর রেললাইন স্থাপন প্রকল্প শতভাগ সমাপ্ত দেখানোর পরও এখানে ইঞ্জিন ভাড়া ও ভ্যাটের ৫৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার-রেনকেনের কাছ থেকে আদায় করা হয়নি। এই প্রকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সরঞ্জাম কেনাকাটা করে আরও ৫০ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। সাপ্লাই, ইনস্টলেশন অ্যান্ড কমিশনিং অব টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম কাজের জন্য ডব্লিউইডি-৮ প্যাকেজের আওতায় দুটি লটে অপটিক্যাল ফাইবার সরবরাহের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নূর-ই ইলাহী অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকার চুক্তি করা হয়। চুক্তি দুটির আইটেম নম্বর-১ থেকে দেখা যায়, ঠিকাদার ৯০ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার সরবরাহ করেছেন। অথচ আইটেম নম্বর-১৭ ও ২০ থেকে দেখা যায়, স্থাপন করেছেন ৮৬ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার। নকশা অনুসারে দুটি লটে মোট ৭৮ দশমিক ১৩৮ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার থাকার কথা। জয়েনিং ও ওয়েস্টেজ বাদে ৭৯ কিলোমিটারের বেশি তার স্থাপন বাস্তবসম্মত নয়। ফলে মজুদে ১১ কিলোমিটার তার থাকবে। কিন্তু তার মজুদে নেই এবং ৯০ কিলোমিটারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এভাবে বিল পরিশোধ করায় ৪৯ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৭ টাকা লোপাট হয়েছে। আরেকটি প্রকল্পে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটা করে ৮০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা লোপাট করা হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ের ঠিকাদারি কাজের চুক্তিপত্র ও বিল পর্যালোচনায় ধরা পড়ে, ১০০ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার ‘ট্র্যাক ডি-স্ট্রেসিং, শ্যালো স্ক্রিনিং অ্যান্ড মেকানাইজড মেইনটেন্যান্স’ কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়। কিন্তু ‘টপ আপ সেস ফর অ্যারেস্ট শোল্ডার ব্যালাস্ট’ আইটেমগুলোতে ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ (অর্থাৎ ২০০ দশমিক ১৮ কিলোমিটার) দেখিয়ে প্রাক্কলন চুক্তি করা হয়। সে মোতাবেক ৮০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা অতিরিক্ত বিলও পরিশোধ করা হয়েছে।

রেললাইনের স্লিপার সরবরাহের কাজেও প্রায় দেড় কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য মিলেছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সেতু প্রকৌশলী (পাকশী কার্যালয়) ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ‘গ্যালভ্যানাইজড এইচ-বিম স্টিল স্লিপার সাপ্লাই অ্যান্ড রিপ্লেসমেন্ট’-এর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নূর-ই ইলাহী অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২ হাজার ৯৫০টি এইচ-বিম স্টিল স্লিপার সরবরাহ করার কথা। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ২৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। কিন্তু এই চুক্তির বিপরীতে তাইওয়ান থেকে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ১২০ কেজি স্লিপার আমদানি করা হয়েছে। ড্রয়িং অনুসারে প্রতিটি এইচ-বিম স্টিল স্লিপারের ওজন ১৬৫ দশমিক ৮২ কেজি। সেই হিসাবে মোট ২ হাজার ৭৯৯টি এইচ-বিম স্টিল স্লিপার আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ দেখানো হয়েছে চুক্তিতে উল্লিখিত ২ হাজার ৯৫০টি। অর্থাৎ চুক্তির চেয়ে ১৫১টি কম সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু বিল পরিশোধ করা হয়েছে ২ হাজার ৯৫০টিরই। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। অডিট প্রতিবেদনে আরও ধরা পড়েছে, ঢালারচর প্রকল্পে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩০০টি বিজি পিএসসি স্লিপার স্থাপন না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেড় কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩ হাজার ৩০০টি ব্রডগেজ পিএসসি স্লিপারের পরিবর্তে ডুয়েল গেজ স্লিপার স্থাপন করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত দেড় কোটি টাকা খরচ দেখিয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এই অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। শুধু রেললাইনে নয়, লুটপাট চলেছে হাসপাতালের কেনাকাটাতেও। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে হাসপাতালের প্রায় ৬ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি টাকার ওষুধপত্র কেনার কোনো ভাউচারই পাওয়া যায়নি। বাকি ৫ কোটি টাকার বিভিন্ন সামগ্রী কেনার জন্য ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হলেও বাস্তবে মালামাল পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের সাম্প্রতিক এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিম রেলের তৎকালীন প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা (সিএমও), প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) এবং ঠিকাদার মিলে এই টাকা লুটপাট করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি রেলের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও উঠে এসেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে হাসপাতালের জন্য পথ্য খাতে ১ কোটি ৩৩ হাজার ৩২ টাকা খরচ করা হয়েছে। ওই বছর হাসপাতালটিতে ২১৮ জন রোগী ভর্তি ছিল। ছয়টি বিলের বিপরীতে এদের জন্য ৭৩ হাজার ১৪৬ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু বাকি ৯৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৬ টাকার কোনো বিল-ভাউচার পাওয়া যায়নি। এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, সিএমও দফতরের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওই অর্থবছরে সিওএস দফতরের মাধ্যমে ৪ কোটি ৯৬ লাখ ২৪ হাজার ৫৮১ টাকার মালামাল কেনা হয়েছে। ঠিকাদারকে বিলও পরিশোধ দেখানো হয়েছে। কিন্তু কেনা এসব স্যানিটারি সামগ্রী স্টকভুক্ত হয়নি। ক্রয়-সংক্রান্ত কোনো চুক্তিপত্র, নোট ও চালান নেই। এতে প্রতীয়মান হয়েছে যে, পরস্পর যোগসাজশে প্রায় ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চলতি বছর জুনে ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদন জাতীয় সংসদে জমা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ৩৬টি অনুচ্ছেদে রেলওয়ের ৪১৯ কোটি ১০ লাখ ২৫ হাজার ৪৬১ টাকার অডিট আপত্তি উঠে এসেছে। এর মধ্যে শুধু পশ্চিমাঞ্চলের টাকার পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘হাসপাতালের দুর্নীতির বিষয়টি রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ধরা পড়েছে। নিরীক্ষার সময়ও পাওয়া গেছে। এ জন্য তৎকালীন সিএমও ডা. ইমতিয়াজ অবসর গ্রহণ করলেও তার পেনশনসহ যাবতীয় পাওনা আটকে আছে। তাকে সবকিছুর হিসাব দিতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর