দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় আত্মহত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-এর এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রতি বছর দেশে আত্মহত্যায় মারা যাচ্ছে ১৩ হাজার মানুষ। এ হিসাবে গড়ে দৈনিক মারা যায় ৩৫ জন মানুষ। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, যারা আত্মহত্যা করছে তারা বয়সে কিশোর ও তরুণ এবং এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই শিক্ষার্থী। এই তালিকায় আরও আছে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, পারিবারিক কলহ, অভিমান, ঋণগ্রস্ত মানুষ, বেকার যুবক, প্রেমঘটিত কারণ, যৌন নির্যাতন এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে মানুষ আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যার হিড়িক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাম্প্রতিক সময় লাইভে এসেও বেশ কজন মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা ভাইরাল হয়ে যায়। এতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। এই অবস্থায় আজ দেশব্যাপী পালিত হবে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘মানসিক স্বাস্থ্য সার্বজনীন অধিকার’। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছেন, করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে শিশু থেকে বয়স্ক এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আগের চেয়ে বেশি মানসিক রোগে আক্রান্ত। এদের কেউ চিকিৎসা নিচ্ছে তো কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে মানসিক বিষাদগ্রস্ত হয়ে এই রোগীরা একপর্যায়ে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হচ্ছে। সম্প্রতি পাবনা মানসিক হাসপাতালে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, মধ্যবয়সীরা এখন বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের ধরন নিয়ে সেখানে বেশি ভর্তি হচ্ছেন। এদের বয়স ৩০ থেকে ৫০ বছর। পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে যে সংখ্যক রোগী ভর্তি হতো তার চেয়ে এখন মাসে গড়ে প্রায় ১ হাজারের বেশি সংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছে। বিশেষজ্ঞরা আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে বিষণ্নতাকে চিহ্নিত করছেন। আত্মহত্যা নিয়ে দেশে যে গবেষণাগুলো প্রকাশিত হয়েছে দেখা যায় এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক চাপে একজন আত্মহত্যা করছে। ক্ষোভের বা লজ্জার প্রকাশ হিসেবে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীও আত্মহত্যা করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আত্মহত্যা মানুষ তখনই করে যখন সে মনে করে তার আর বাঁচার আর কোনো জায়গা নেই। একজন যখন দেখেন যে, সে একা হয়ে গেছে, জীবনের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না এবং তার সংগ্রামের যে ধারাবাহিকতা তা আর সে নিতে পারছে না তখনই তিনি আত্মহত্যা করেন। আমরা এখন ভীষণ যান্ত্রিক জীবনে চলে যাচ্ছি।
আত্মহত্যা বাড়ছে শিক্ষার্থীদের : স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ক্রমবর্ধমান : কোন পথে সমাধান’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনে জানানো হয় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আট মাসে ৩৬১ জন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদরাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। ২০২২ সালে আত্মহত্যা করে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী। চলতি বছর আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল স্কুলশিক্ষার্থী। আত্মহত্যার ঘটনায় সবচেয়ে এগিয়ে ঢাকা বিভাগ। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পড়ালেখা ও বেড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ না থাকায় আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহত্যা করছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে অন্যতম কারণ অভিমান। এ ছাড়াও ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক অতিরিক্ত সামাজিক চাপ এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মাঝে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায়। এ থেকেও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশই বিষণ্নতায় ভুগছে। এটা আমাদের জন্য অশনি সংকেত। একজন শিক্ষার্থী যখন বিষণ্নতায় ভোগে তখন সে কোনোকিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না। বিষণ্নতা হচ্ছে আত্মহত্যার প্রাথমিক ধাপ। বিষণ্নতায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ পরবর্তীতে আত্মহত্যা করে। আগে শিক্ষার্থীরা এত বেশি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতো না কিন্তু এখন হচ্ছে। এটি উদ্বেগজনক। এই সমস্যা থেকে উত্তরণে এক পাক্ষিক কোনো সমাধান নেই। যে বিষয়গুলো আমাদের মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেসব বিষয় থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।
কেন আত্মহত্যা বাড়ছে : মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে এখন মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে সে কারণে আত্মহত্যার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ যখনই বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে এবং অন্য মানুষের সঙ্গে তার বন্ধন কমতে থাকে তখন তার পক্ষে আত্মহত্যা করা অনেক সহজ। আমাদের এখন এক ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যে বড় হয়ে উঠছে সেখানে এক ধরনের সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে যে কিশোর ও তরুণরা একক পরিবারে বড় হয়ে উঠছে এবং যাদের পারিবারিক বন্ধন আগের তুলনায় শিথিল হয়ে পড়ছে তাদের সমস্যা বাড়ছে। দিন যত যাচ্ছে মানুষের মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আগে সন্তানদের ওপর অভিভাবকদের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল তা এখন কমে এসেছে। এই পরিবেশে শিশু-কিশোরদের যে ব্যক্তিত্ব গঠিত হচ্ছে এতে তাদের মানসিক চাপ সহ্য করার যে ক্ষমতা তা কমে যাচ্ছে। এটি আত্মহত্যা করার একটি কারণ। আবার শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে যারা বিচ্ছিন্ন এবং বিয়ে করেনি এমন মানুষদের মধ্যে আত্মহত্যা করার হার বেশি। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে সবকিছুতেই জীবন খুব ‘স্ট্রেসফুল’। বিশেষ করে ঢাকায় মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা দেশের অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি। ঢাকায় রাস্তায় বের হলেই মানসিক চাপ শুরু হয়। যেখানে অভিভাবক, সন্তান ও আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে মানুষের একসঙ্গে বেঁচে থাকার কথা সেখানে দেশে এখন ‘ফ্ল্যাট সংস্কৃতি’ চলছে। শহরে সবাই যার যার ফ্ল্যাটে থাকেন কিন্তু এই সংস্কৃতিতে একজন তার প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেন না। এত কাছে থেকেও একজন প্রতিবেশী আরেকজনের খোঁজ নিচ্ছেন না। এটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটি অংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যারা মানসিকভাবে অসুস্থ এবং যাদের সেবা দরকার তাদের বাসায় বসে থাকলে হবে না। অনেকেই আছে যারা মানসিক সমস্যা নিয়ে বাসায় বসে আছেন। তাদের জন্য বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা আছে। তারা যদি সশরীরে এই সেবা নিতে চান তাহলে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাও আছে। মানসিক রোগীরা কোথায় গেলে সেবা পাবেন তা জানানোর জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এতে আত্মহত্যার ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।