সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আইডিয়াল স্কুলে কয়েক শ কোটি টাকার দুর্নীতি

চাঞ্চল্যকর তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে

আকতারুজ্জামান

রাজধানীর খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কয়েক শ কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শত শত শিক্ষক-শিক্ষিকা কর্মচারী। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধভাবে এবং অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। আর নিয়োগ দেওয়া শিক্ষকের কেউ ভুয়া সনদধারী, আবার কারও রয়েছে জাল সনদ। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে সরকারি তদন্তে। মহামারি করোনাভাইরাসের সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও এই সময়ে খরচ দেখানো হয়েছে ৬৪ লাখ টাকার বেশি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) গত বছরের জুনে সরেজমিন পরিদর্শন করে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

অনিয়মের মাধ্যমে খরচ করা বিভিন্ন অর্থ ও বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ফেরত দিতে বলা হয়েছে সরকারের কোষাগারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মতিঝিলের বনশ্রী শাখা ১৯৯৬ সালে চালু করা হয়। এখানে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন ২৭২ জন। কিন্তু এই ক্যাম্পাস চালুর কোনো অনুমতি বা স্বীকৃতিপত্র নেই। এ ক্যাম্পাসটি পৃথকভাবে এমপিওভুক্তও করা হয়নি। ভবিষ্যতে এই শাখার শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমপিও না দিতে সুপারিশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। বলা হয়েছে, বনশ্রী শাখার বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে মোট ১৪ কোটি ৯০ লাখ ৫ হাজার ৪১ টাকা হাতে রেখে খরচ করা হয়েছে। এটি বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে তদন্ত কমিটিকে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা নগদে রাখার নিয়ম রয়েছে। বিধান লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে। প্রতিষ্ঠানটির মুগদা শাখায় বিধি লঙ্ঘন করে হাতে রেখে খরচ করা হয়েছে ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৩২ হাজার ১১ টাকা। এই অনিয়মের কারণেও প্রতিষ্ঠান প্রধান ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মতিঝিল শাখায় ২০১১ সালে ১১১ জন শিক্ষক ও একজন ল্যাব সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগের রেকর্ডে অনিয়ম পাওয়া গেছে। এই শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি উল্লেখ করে তা বাতিলের পাশাপাশি তাদের গৃহীত বেতন-ভাতা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বলেছে। এদিকে ২০১৩ সালে এই প্রতিষ্ঠানে ১৪২ জন শিক্ষক ও তিনজন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের নিয়োগেও অনিয়মের প্রমাণ মেলে। ২০১৮ সালে বিধিবহির্ভূতভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আরও ৮৯ জনকে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বনশ্রী শাখার ৬৯ জনকে শিক্ষক হিসেবে ২০১৮, ২০১৯, ২০২১ সালে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। এই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাবদ নেওয়া অর্থ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। মুগদা শাখায় বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ করা হয়েছে ৩৮ জনকে। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া সবার নিয়োগ বাতিলের সুপারিশের পাশাপাশি এই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ গৃহীত প্রায় দেড় শ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়েছে। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিটি শাখা থেকে পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা নিয়ম না থাকা সত্ত্বেও সম্মানী গ্রহণ করেছেন ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৬ টাকা। প্রতিটি সভায় সভাপতি ২৫ হাজার এবং প্রত্যেক সদস্য ৬ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। যা হাস্যকর বলছে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা একাই প্রতিষ্ঠানের তিন শাখা থেকে দায়িত্ব ভাতা ও বার্ষিক ভাতা গ্রহণ করেছেন। অনিয়মের মাধ্যমে নেওয়া তার ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে আর্থিক নানা কেনাকাটায় প্রমাণ মিলেছে বড় অসঙ্গতির। ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজগুলো বিধিবহির্ভূতভাবে সম্পাদিত এবং ৩১ কোটি ২০ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮৪ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এসব কাজ সম্পাদনের পূর্বে প্রাক্কলন প্রণয়ন করা হয়নি, যা বিধির ব্যত্যয় হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এ ছাড়া ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত পণ্য কেনাকাটা বাবদ ৪৮ কোটি ৯০ লাখ ৫ হাজার ৬৫৩ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়নি, যা নিয়মের ব্যত্যয় করেছে। এ প্রতিষ্ঠানের ক্রয় প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ- বলছে তদন্ত প্রতিবেদন। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালের মে থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও ব্যয় করা হয়েছে ৬৪ লাখ ২৩ হাজার ৫৮১ টাকা- যা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, প্রতিষ্ঠানের সব শাখায় যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ সাধারণ ও সংরক্ষিত তহবিলে জমা আছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে অকারণে বিভিন্ন নামে ফি আদায় করা হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফির পরিমাণও যথেষ্ট বেশি বলে তদন্ত দল মনে করে। অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের টিউশন ও অন্যান্য ফির হার কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি গত মাসে দায়িত্ব নিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন এখনো হাতে পাইনি। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর গভর্নিং বডির বৈঠকে এ ব্যাপারে আলোচনা শেষে ব্যবস্থা  নেওয়া হতে পারে।

সর্বশেষ খবর