প্রাকৃতিকভাবে অনিন্দ্য সুন্দর। মনোরম পরিবেশের জন্য অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমীদের প্রিয় স্থান হওয়ার কথা জাপানের ফুজি পর্বতমালার পাদদেশের জঙ্গল ‘আওকিগাহারা’; কিন্তু এ অপরূপ জঙ্গলকে আত্মহত্যার জন্য বেছে নিয়েছেন জাপানিরা। বছরে ১০০ জাপানি আত্মহত্যা করেন অনিন্দ্য সুন্দর এই জঙ্গলে। জীবনের শেষ মুহূর্তের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া জঙ্গলে অনেকেরই লাশের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। জাপানিরা অধিক হারে আত্মহত্যার জন্য বেছে নেওয়া ‘আওকিগাহারা’ জঙ্গল পরিচিতি পেয়েছে ‘সুইসাইড ফরেস্ট’ হিসেবে। ‘নিঃসঙ্গ মন্ত্রী’ নিয়োগেও থামছে না আত্মহত্যার প্রবণতা।
জাপানের রাজধানী টোকিওর প্রবাসী বাংলাদেশি সোলায়মান হোসেন সালমান বলেন, ‘জাপানিরা বিশ্বের অন্যতম আত্মহত্যাপ্রবণ জাতি। আত্মহত্যার জন্য তারা আওকিগাহারা জঙ্গলকেই বেছে নেন। এ জঙ্গলে প্রতি বছর কমপক্ষে ১০০ জাপানি আত্মহত্যা করেন। অনেকের মৃতদেহ খুঁজেও পাওয়া যায় না। লাশ উদ্ধারে সরকারেরও নেই কোনো পদক্ষেপ।’
জাপানি জাতীয় সমীক্ষা বলছে, জাপানে নারীর তুলনায় পুরুষের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। প্রতি বছর এ দেশে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। সারা বিশ্বে আত্মহত্যাপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ে জাপান এগিয়ে। এ দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আত্মহত্যার হার কমাতে ‘নিঃসঙ্গ মন্ত্রী’ও নিয়োগ দিয়েছে জাপান সরকার। তার পরও থামছে না আত্মহত্যা। জানা যায়, জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে বিখ্যাত মাউন্ট ফুজি পর্বতের উত্তর-পশ্চিম পাদদেশে ‘আওকিগাহারা’ জঙ্গলের অবস্থান। স্থানীয়দের কাছে জঙ্গলটি কুখ্যাত ‘সুইসাইড ফরেস্ট’ হিসেবে পরিচিত। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা বনটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে মৃত মানুষের দেহ, কঙ্কাল ও হাড়গোড়। আওকিগাহারা ফরেস্টে যান অনেক জাপানি। তবে পর্যটক হিসেবে নয়। উদ্দেশ্য নিজেকে বিসর্জন দেওয়া। ৩৫ বর্গকিলোমিটারের সুবিশাল জঙ্গলে একবার প্রবেশ করলে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অদ্ভুত বাঁকানো আকৃতির গাছপালা ও গাছের শিকড়- এ জঙ্গলের রহস্য বাড়িয়েছে বহু গুণ। পাহাড়ি এ জঙ্গলে রয়েছে হাজারো গর্ত ও অন্ধকার গুহা। এ জঙ্গলের মাটিতে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেটিক আয়রন। তাই এই জঙ্গলে মোবাইল ফোন, জিপিএস সিস্টেম ও কম্পাস কাজ করে না। জাপানি পুরাণ মতে, ‘সুইসাইড ফরেস্ট’ আওকিগাহারা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় লাখ লাখ মানুষের আত্মা। জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো প্রেতাত্মারা মানুষকে প্ররোচিত করে আত্মহত্যার। তাই জাপানিরা ছুটে যান ঘন গাছপালা, গুমোট নিস্তব্ধ জঙ্গলে আত্মহত্যার জন্য। জাপান সামুরাই নীতিতে বিশ্বাসীরা মনে করেন, আত্মহত্যার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়। সেই বিশ্বাস থেকেই এ জঙ্গলে আসেন আত্মহত্যা করতে। এ জঙ্গলে বছরে গড়ে শতাধিক জাপানি আত্মহত্যা করেন। ১৯৬০ সালে জাপানি লেখক সাইকো মাটসুমোটোর লেখা উপন্যাস ‘টাওয়ার অব ওয়েবস’ প্রকাশ হয়। এ উপন্যাসের দুটি চরিত্র এ জঙ্গলে এসে আত্মহত্যা করেছিলেন। ওই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর আওকিগাহারা বনে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। ২০১৬ সালে আমরিকার হরর মুভি ‘দ্য ফরেস্ট’-এ দেখানো হয় দুই যমজ বোন এ জঙ্গলে এসে গায়েব হয়ে যায়। ১৯৭০ সালে পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক এবং সাংবাদিকদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়। ওই দলের মূল কাজ ছিল আওকিগাহারা থেকে লাশ খুঁজে বের করা। একই সঙ্গে জাপানিদের আত্মহত্যায় নিরুৎসাহী করা। আত্মহত্যার হার কমানোর জন্য আইনও পাস করা হয়। সুইসাইড ফরেস্টে প্রবেশে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়; কিন্তু তার পরও কমানো যায়নি আত্মহত্যার হার।