দায়িত্ব গ্রহণের পর বৈষম্য দূর ও রাষ্ট্রকাঠামোয় সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাড়ানো হচ্ছে সরকারের পরিধি। প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল চলছে। বৈষম্য দূরের আশা নিয়ে প্রতিদিনই নতুন এ সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের কেউ বিক্ষোভ করছেন রাস্তায়, কেউ করছেন মানববন্ধন, কেউ স্মারকলিপি দিচ্ছেন সরকারের কাছে। দাবি আদায়ে গতকালও রাজধানীতে বিভিন্ন পেশার মানুষকে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়।
গ্রামপুলিশ সদস্যদের সড়ক অবরোধ : চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবি আদায়ে সড়কে নেমে এসেছেন গ্রামপুলিশের সদস্যরা। গতকাল সকাল থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়ক অবরোধ করে গ্রাম পুলিশের প্রায় ৫ শতাধিক সদস্যকে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে দেখা যায়। এতে পল্টন থেকে মৎস্য ভবনমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেওয়া গ্রাম পুলিশের সদস্যরা বলেন, তারা দিন-রাত ডিউটি করেও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। তাই তারা তাদের চাকরি জাতীয়করণ চান। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না বলে জানান। প্রয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে গিয়েও আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা।
চাকরি জাতীয়করণ চায় আইজিএ প্রকল্পের কর্মীরা : মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপজেলা পর্যায়ে মহিলাদের জন্য আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ প্রকল্পে কর্মরত জনবলকে রাজস্বকরণের সুপারিশ অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে মহাসমাবেশ করেছেন প্রশিক্ষক ও কর্মচারীরা। গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সরকারি গেস্ট হাউস যমুনার সামনে তারা মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন। তারা বলেন, আইজিএ প্রশিক্ষণ প্রকল্পের ৯৫ ভাগ প্রশিক্ষকই নারী, যাদের অধিকাংশই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী, অনেকে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। একাধিকবার মেয়াদ বৃদ্ধি করার কারণে কর্মরত জনবলের অন্য কোনো সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা নেই। প্রকল্পটি ৩০ জুন ২০২৩ সমাপ্ত হয়ে যায়। নারীদের আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা রাখায় সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এপ্রিল ২০২২ এডিপি সভায় আইজিএ প্রশিক্ষণ প্রকল্পের জনবলের পদসৃজন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফাইলটি বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন। অবিলম্বে প্রকল্পে কর্মরত জনবলকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা।
‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের নারীদের এক দফা দাবি : মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পে কর্মরত নারীরা রাজস্ব খাতে চাকরি স্থানান্তরের এক দফা দাবি জানিয়েছেন। এ দাবিতে গতকাল সকালে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। তারা বলেন, ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পে ২ হাজারের বেশি নারী কর্মরত রয়েছেন। সবাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শেষ হয়ে এখন দ্বিতীয় পর্যায় চলছে। আমাদের বলা হয়েছিল, বর্তমান জনবলসহ প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে নেওয়া হবে। গত ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা আর চুক্তিভিত্তিক কাজ করতে চাই না, রাজস্ব খাত চাই, চাকরির নিশ্চয়তা চাই।
চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের অবস্থান সদর দপ্তরে অবরুদ্ধ আইজিপি : চাকরি ফিরে পেতে পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা। বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালন করেন গত ১৫ বছরের বিভিন্ন সময়ে চাকরি হারানো হাজারো পুলিশ সদস্য। এ সময় পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদর দপ্তরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সরেজমিনে দেখা গেছে, সদর দপ্তরের সামনের সড়কের দুই লেন বন্ধ করে তারা বিক্ষোভ ও অবস্থান করলেও বিকাল প্রায় ৫টা পর্যন্ত পুলিশপ্রধান বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কারও দেখা মেলেনি। এ সময় তারা নির্বাহী আদেশে চাকরি ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়ে নানা স্লোগান দেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা কনস্টেবল ফরহাদ বিশ্বাস বলেন, ২০২১ সালে বগুড়া জেলায় আমাকে ডোপ টেস্টের নামে চাকরিচ্যুত করা হয়। আদালতে মামলা করি। আদালত থেকে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও এসপি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী আমাকে যোগদান করতে দেননি। তিনি বলেন, এরকম হাজারো পুলিশ সদস্য হাহাকার নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আমাদের দাবি একটাই, নির্বাহী আদেশে চাকরি ফেরত দেওয়া হোক। আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যরা বলছেন, বিগত সময়ের বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তারা যদি চাকরি ফিরে পান তাহলে আমরা কেন পাব না। বিশেষ করে বিভাগীয় মামলা ও আদালতের আশ্রয় নিয়ে তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় যারা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন, তাদের কী দোষ! তাদের তো চাকরি বহালে কোনো বাধা থাকার কথা নয়।
চাকরিতে পুনর্বহাল চান বিডিআর সদস্যরা : ২০০৯ সালে পিলখানা বিদ্রোহের নামে ও বিদ্রোহের দায়ে ‘মিথ্যা ও অন্যায়ভাবে’ বিডিআরের ৭৬তম ব্যাচের ৫১৬ জন সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে দাবি করে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (সাবেক বিডিআর) ওই ব্যাচের সদস্যরা। এ দাবিতে গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। তারা দাবি করেন, বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তার পরও অভিযোগ দিয়ে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এমনকি ৭৬তম ব্যাচের সব সদস্যকে অন্য কোনো বাহিনীতে চাকরি নেওয়ার সুযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯ দাবি : খাদ্য অধিদপ্তরাধীন বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদমর্যাদা, বেতন স্কেল, পদোন্নতি এবং দলীয় বিবেচনায় পদায়নের বৈষম্যসহ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষম্য, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধসহ ৯ দফা দাবিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী খাদ্য অধিদপ্তরের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা শেষে দেওয়া স্মারকলিপিতে বিগত স্বৈরশাসকের ১৬ বছরে সৃষ্ট বিভিন্ন বৈষম্য তুলে ধরা হয়।
বন্দিদের মুক্ত করতে ট্রাইব্যুনালের সামনে পরিবারের মানববন্ধন : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কারাগারে থাকা আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছেন ভুক্তভোগী আসামিদের পরিবারের সদস্যরা। গতকাল সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, শেখ হাসিনা তার স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করতে নিরপরাধ ব্যক্তিদের মিথ্যা মামলা দিয়ে বন্দি রেখেছে। অবিলম্বে কথিত মানবতাবিরোধী মামলা প্রত্যাহার করে কারাবন্দি সবাইকে মুক্তি দিতে হবে। মানববন্ধন শেষে আইন উপদেষ্টা বরাবর আসামিদের মুক্তির দাবিতে স্মারকলিপি পেশ করা হবে বলে জানানো হয়।