শিরোনাম
সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

শেয়ারবাজার হরিলুটের মাস্টারমাইন্ড মিজান

আছেন বহাল তবিয়তে

নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ারবাজার হরিলুটের মাস্টারমাইন্ড মিজান

আওয়ামী লীগ আমলে শেয়ারবাজারে হরিলুটের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। লুটেপুটে খাওয়া সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরোর নেপথ্য কারিগর ছিলেন এই মিজান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাউঞ্জে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে আধুনিকায়ন করেন তিনি। হিরোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে এই কাজ করার জন্য তিনি নানা সমালোচনার জন্ম দেন। অন্যদের নিয়ে আলোচনা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন শেয়ারবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতানো এই মাস্টারমাইন্ড। শেয়ারবাজার লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এই মিজানের নাম কোথাও আসছে না। তিনি এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করা হলেও তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

গত কয়েক বছরে শেয়ারবাজারে কারসাজি সিন্ডিকেটের একাধিক ব্যক্তির নাম এসেছে। এর অন্যতম কারসাজি সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল খায়ের হিরো। শিক্ষকতার আড়ালে শেয়ারবাজারে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অধ্যাপক মিজান। হিরো ও মিজান সিন্ডিকেটের সব কারসাজিতে প্রশ্রয় দিয়েছেন তৎকালীন চেয়ারম্যান। হিরোর কারসাজির সব তথ্যপ্রমাণ বিএসইসির কাছে রয়েছে। কোন ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে, কবে, কখন, কীভাবে এবং কার সঙ্গে মিলে কোন শেয়ার নিয়ে হিরো কারসাজি করেছেন সব জানে এ সংস্থা। এসব তথ্যপ্রমাণ ঘাঁটলে ড. মিজানের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও স্পষ্ট হবে। কিন্তু সব প্রমাণ থাকার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হিরো মাত্র তিন থেকে চার বছরের ব্যবধানে হাজার কোটির বেশি টাকা লোপাট করেছেন। এই হিরো গংদের অন্যতম নেপথ্য ব্যক্তি ছিলেন অধ্যাপক মিজান। অধ্যাপক মিজান আবুল খায়ের হিরোর সঙ্গে মিলে শেয়ারবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন। হিরোর নাম গণমাধ্যমে এলেও তার উত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছেন এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ লোপাটে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন অধ্যাপক মিজান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মীদের মধ্যে ক্ষমতায় পটপরিবর্তনে ভোল পাল্টানোর জন্য সুপরিচিত। মিজানের সঙ্গে হিরো যোগাযোগ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। হিরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হলে মিজান ছিলেন সেই কোর্সেরই শিক্ষক। পরে ছাত্র শিক্ষক মিলে গড়ে তোলেন শেয়ার জালিয়াতির সিন্ডিকেট। শেয়ার ব্যবসায় নেমে এক বছরের মধ্যেই ঢাকার বনানীতে প্রায় ৩ কোটি টাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন। বিএসইসির চেয়ারম্যান পদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করা অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত উল ইসলামের সময়ে তারা এক জোট হয়ে লুটপাট করেছেন শেয়ারবাজারে। অদ্ভুত পদ্ধতিতে এই দুজন মিলে শেয়ার কেনাবেচা করেছেন। এই শেয়ার কেনাবেচায় হিরো ব্যবহার করেছেন অধ্যাপক মিজানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। হিরোর নামে-বেনামে বিভিন্ন বেনিফিসিয়ারি ওনার (বিও) অ্যাকাউন্ট করে তাতে লেনদেন করেছেন। বিএসইসি বা ডিএসইর কোনো সার্ভিলেন্সে নজরদারি এড়াতে এসব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছেন। এই লেনদেনে ব্যবহার করা হয়েছে অধ্যাপক মিজানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। যার কারণে ডিএসইর সার্ভিলেন্সে তার নাম ধরা পরেনি। হিরোর শেয়ার জালিয়াতি তদন্ত করতে গিয়েই মূলত অধ্যাপক মিজানের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়। এই লেনদেনের ঘটনাগুলো সামলে এলে হিরোর বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও অধ্যাপক মিজানের নামে কোনো তদন্ত হয়নি। হিরোকে শেয়ারবাজারের খলনায়ক বানিয়ে তোলার পেছনে মূল কারিগর যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বরাবরই রয়ে গেছেন আড়ালে। বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামেরও অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন মিজান। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিবলী এবং হিরোরা বেকায়দায় পড়লেও অধ্যাপক মিজান আছেন বহাল তবিয়তে। ভোল পাল্টে এখন নতুন প্রেক্ষাপটে মিশে যাওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাংকের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের জন্য বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ত্রাণ তহবিলে টাকা হস্তান্তর করা হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ড. মিজান। কিন্তু তিনি ওই ব্যাংকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাংকের কেউ না হয়ে সেই অনুষ্ঠানে মিজান কীভাবে উপস্থিত হলেন? নিজের অপকর্ম ঢাকতে এবং বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আনুকল্য পেতে ওই ব্যাংকের বিতর্কিত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওই আয়োজনে উপস্থিত হয়েছিলেন মিজান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান একসময় বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সহকর্মীর সঙ্গে খারাপ আচরণ এবং গায়ে হাত তোলার ঘটনায় তাকে ২০২৩ সালের এপ্রিলে ঢাবি সাদা দলের সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। হিরোর মতো বিতর্কিত ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ও টিচারস লাউঞ্জ আধুনিকায়ন করেও সমালোচনার জন্ম দেন মিজান। এসব বিষয় নিয়ে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, আবুল খায়ের হিরোর সঙ্গে আমার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, এর বাইরে কিছু নেই। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হলে হিরোর সঙ্গে তার ব্যাংক হিসাবে অর্থ লেনদেন কী করে হলো- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বনানীতে কেনা ফ্ল্যাটটি হিরোর কাছে বিক্রি করেছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে হিরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ও টিচারস লাউঞ্জ আধুনিকায়ন করলেন কী করে- এমন প্রশ্নে ড. মিজান বলেন, যার সামর্থ্য আছে, তিনি অনুদান দিতে পারেন। সরকারি কর্মকর্তা নয়, ছাত্র হিসেবেই অনুদান নেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর